প্রকৃতি পরিবেশ ও কীটপতঙ্গ

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ০৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও পরিবেশ রক্ষার দায়ভার যে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা সমগ্র মানবজাতির, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু সেই গুরুত্ব আমাদের উপলব্ধি করতে বহু যুগ অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। সভ্যতার অগ্রগতির নেশায় বুঁদ হয়ে মানুষ উপলব্ধি করতে পারেনি যে, বিকাশের উদভ্রান্ত লোভে সে ধীরে ধীরে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে ফেলছে। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার এই প্রয়োজনীয়তা মাথায় রেখে ১৯৭২ সালে UN General Assembly তে প্রতি বছর জুন মাসের ৫ তারিখ বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তার দু’বছর পর ১৯৭৪ সালে যখন প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয় তার মূল বিষয় ছিল- Only One Earth। আমাদের ‘একটাই মাত্র পৃথিবী’ এই বোধ দিকে দিকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে গত কয়েক দশকে World Enviroment Day (WED) বিশ্বব্যাপী একটা মঞ্চ হিসেবে গড়ে উঠেছে, যেখানে এর সদস্য দেশগুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশ সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। পৃথিবীজুড়ে এই সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে প্রতি বছর পরিবেশ দিবস উদযাপনের জন্য নানা অনুষ্ঠান আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। ভাবলে অবাক লাগে, আজ সারা পৃথিবীর শতকরা ৯২ শতাংশ মানুষ বিশুদ্ধ বায়ু থেকে বঞ্চিত। এই আলোচনার শিরোনাম দেখে আপাত-দৃষ্টিতে মনে প্রশ্ন আসা অস্বাভাবিক নয় যে, পৃথিবীজুড়ে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় তথাকথিত ‘সর্ব শ্রেষ্ঠ জীব’ মানুষের যে ভূমিকা, সেই তুলনায় নিতান্ত তুচ্ছ ও নগণ্য উপস্থিতি ও ভূমিকা যেখানে কীট ও পতঙ্গের, সেখানে কোনো আলোচনার কেন্দ্রে এদের উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয় নয় কি? তা যে নয় তার সমর্থন মেলে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী ও গবেষক ফ্রান্সিস্কো সানচেজ বেও-র লেখায়। তাঁর মতে, প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রতিটি উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমান ভূমিকা। কারণ, সবাই একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। এ প্রসঙ্গে বেও বলেন, কীট-পতঙ্গের বিলুপ্তি হওয়া যদি খুব সত্বর বন্ধ করা না যায়, তাহলে তা পৃথিবীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস করবে এবং মানবজাতির ভবিষ্যতের জন্য মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে (Biological Conservation, vol, 232, April 2019)। কীট পতঙ্গের সঙ্গে মানব সভ্যতা, জীবনযাপন আদিকাল থেকেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মৌমাছির কথাই ধরা যাক। এদের শরীরে সৃষ্টি হওয়া মধু বিভিন্ন সামাজিক কাজে ব্যবহৃত হয়। মধুকে বলা হয়, বিশ্বের প্রথম প্রাণীজাত মিষ্টি দ্রব্য। একটি মানুষ জন্মের পর থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি অনুষ্ঠানে মধুর ব্যবহার অপরিহার্য। প্রায় প্রতিটি জেলায় মৌমাছির চাষ হয়। তার মধ্যে সুন্দরবন অঞ্চলেই বেশি মধু উৎপাদিত হয়ে থাকে। দেশের অর্থনীতিতে মৌমাছির অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশকে Land of Honey বলা চলে। বাংলাদেশে পাঁচ প্রজাতির মৌমাছি পাওয়া যায়। এপিস (Apis) জাতির অন্তর্গত পাঁচ প্রজাতির মধ্যে এপিস মেলিফেরা (Apis mellifera) থেকে সব থেকে বেশি মধু পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশের মৌমাছি বা (Bangla Bee) নামে পরিচিত। আমাদের দেশে প্রায় লক্ষাধিক চাষি এই মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। তার মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার মধু সংরক্ষণকারী ৭৫ হাজার মৌচাকের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে থাকে। চাষিদের নিজের জমি না থাকলেও মধু চাষ করা সম্ভব। মৌমাছি জঙ্গলেও চাষ করা যায়। তাই বনবাদারে বাঘ বা অন্য বন্যপ্রাণীর আক্রমণে মধু সংগ্রহকারীর মৃত্যুর খবর মাঝেমধ্যেই পত্রপত্রিকায় খবর হয়। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে মৌমাছি চাষের প্রচার, প্রসার ও নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সঙ্গে চাষিদের পরিচিত করে তোলার উদ্দেশ্যে ১৯৬২ সঙ্গে The Central Bee Research Traning Institute প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদের দেশেও মধু চাষে কৃষি বিজ্ঞানীরা মৌচাষে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। কারণ, এ দেশেও মধু চাষ করার ব্যাপক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। মৌমাছিদের জীবন স্টাইল কিন্তু সুন্দর এবং চমৎকার। একটি মৌচাকের মধ্যে একটি রানী থাকে আর কয়েক হাজার পুরুষ কর্মী মৌমাছি থাকে। যুথবদ্ধ প্রজননের জন্য প্রস্তুত করানো হয়। পুরুষ মৌমাছিরা প্রজননের ঠিক পরেই মৌচাক থেকে বেরিয়ে পড়ে। কর্মী মৌমাছিরা ভীষণ পরিশ্রমী হয়। সাধারণত বসন্তকালে ওরা ফুল থেকে (Proboscis) দিয়ে নেক্টার বা মধু সংগ্রহ করে। মৌমাচির দুটো পাকস্থলী। একটাতে প্রাত্যহিক খাবার জমা থাকে, আরেকটাতে ফুল থেকে নেক্টার সংগ্রহ করে তা জমা রাখে। পরে এই নেক্টার আর ওদের শরীরের উৎসেচক বা বহুসব মিলে মধু তৈরি হয়। তারপর মৌচাকে এক একটা কোঠাতে সেই মধু জমিয়ে রাখে। কর্মী মৌমাছিরা দূর-দূরান্ত থেকে নেক্টার সংগ্রহ করে আনে। এদের মধ্যে কেউ আবার অনেক দূর অবধি উড়ে গিয়ে নতুন জায়গার সন্ধান নিয়ে এসে মৌচাকে থাকা অন্য সকল কর্মীর এক ধরনের বিশেষ নৃত্যের সাহায্যে সেটা জানিয়ে দেয়। মৌমাছিদের সঙ্গবদ্ধ গোষ্ঠীজীবন এইভাবে পরোক্ষ মানুষেরই বিভিন্ন চাহিদার জোগান দেয়। প্রকৃতিতে আরো এমন অনেক ধরনের কীট ও পতঙ্গ আছে, যাদের গুরুত্ব মানুষের জীবনে অপরিসীম। এড়ি এবং মুগা এক ধরনের প্রজাপতি, যার থেকে সিল্ক বা রেশম সুতা উৎপাদন হয়। এই শুয়োপোকা জাতীয় পতঙ্গ ডিম থেকে ফুটে সম্পূর্ণ বড় হতে প্রায় ৪২-৪৫ দিন লাগে। এরা একসঙ্গে ৪০০-৫০০ ডিম পাড়ে। ৯-১১ দিনের মধ্যে ডিম ফেটে গুটিপোকা বেরিয়ে আসে। এই গুটিগুলো থেকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে পোকা সরিয়ে সিল্ক বা রেশম সুতা উৎপন্ন করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে, এই ধরনের পোকা চাষ হয়। এর ফলে এড়ি ও মুগা পোকা থেকে উৎপাদিত রেশম শিল্পের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে প্রচুর প্রভাব পড়ে। তাই সরকারি উদ্যোগে এই পোকাদের সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। রেশম সিল্ক থেকে তৈরি বস্ত্র আভিজাত্যের পরিচায়ক। ১৭৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথমে বাংলায়-এর চাষ শুরু করে। ধীরে ধীরে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, নাগাল্যান্ড ও মনিপুরে এর চাষ ছড়িয়ে পড়ে। আজ ভারতের কর্নাটকে সব থেকে বেশি রেশম গুটি থেকে সিল্ক উৎপাদন হয়। আসামের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বরাক উপত্যকার দুর্লভছড়া, ঝাঁপিরবন্দ, আদরকোণা, পয়লাপুল, দর্মিখাল, ঠালিগ্রাম ইত্যাদি স্থানে এড়ি এবং মুগা চাষ হয়। আমাদের দেশের অর্থনীতিতে এই শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সরকারি ও বেসরকারি সেরিকালচার বিভাগে চাকরির সুযোগ রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এড়ি এবং মুগা চাষে প্রচুর কর্মসংস্থান হতে পারে। আরো এক ধরনের পোকা মানুষের জীবনযাপনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এদের লাক্ষাপোকা বা Lac Insect বলা হয়। এ ধরনের পোকার মুখ থেকে যে রস নিঃসৃত হয় তা থেকে লাক্ষা বা Lac তৈরি হয়। এই লাক্ষা পোকার চাষ প্রথমে অবিভক্ত ভারতবর্ষে শুরু হয়। বর্তমানে ভারতের ঝাড়খণ্ড সব থেকে বেশি লাক্ষা উৎপাদনকারী রাজ্য। সে রাজ্যে লাক্ষা উৎপাদন ভারতের মোট উৎপাদনের ৫৭ শতাংশ প্রায়। এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িষ্যা ও মহারাষ্ট্রে লাক্ষা চাষ হয়। খুব স্বল্প পুঁজিতে এই শিল্প শুরু করা যায়। এই শিল্প উৎপাদনে পলাশবৃক্ষ বা কুসুম বৃক্ষের মতো পোকার অতিথি গাছ বা হোস্ট প্লান্ট প্রয়োজনীয়। ইন্সুলেটর, ঘরের মেঝে পালিশ, জুতো পালিশ, কসমেটিকস ইত্যাদি বানানোর মতো কাজে লাক্ষা ব্যবহৃত হয়। কীটপতঙ্গের উপস্থিতিতে এভাবে শুধু মানবজাতি নয়, সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেমই উপকৃত হয়। মৌমাছি ও প্রজাপতির মতো পতঙ্গ ফুল এবং ফলের প্রজননে সাহায্য করে। কীট-পতঙ্গ, মানুষ ও পশু-পক্ষীর খাদ্যের চাহিদা মিটায়। আবর্জনা থেকে সার তৈরি করতে কীটপতঙ্গের বিশাল ভূমিকা আছে। কিছু কিছু পোকা Indicator species নামে পরিচিত। এদের উপস্থিতি থেকে জলাশয়ের পানি পরিষ্কার না দূষিত তা বোঝা যায়। আশঙ্কার কথা, সারাবিশ্বে প্রতি বছর প্রায় আড়াই শতাংশ হারে কীটপতঙ্গের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এই হারে হ্রাস পেতে থাকলে ভবিষ্যতে পৃথিবী থেকে কীটপতঙ্গ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাবে। কীটপতঙ্গ বাঁচিয়ে রাখা যে কত জরুরি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই প্রসঙ্গে ড. ফ্যান্সিস্কো সানচেজ বেও-র প্রণিধানযোগ্য সাবধানবাণী, If we don`t stop it, entrie ecosystems will collapse due to starvation. কীটপতঙ্গের সংখ্যা লোপ পাওয়ার কারণের মধ্যে উষ্ণায়ন, নগরায়ন, অরণ্যবিনাস, (deforstation) মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহার করা, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি উল্লেখ্যযোগ্য। অতএব, কীটপতঙ্গ, পশু-পাখি, বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, গবাদিপশুসহ সকল প্রকার প্রাণীর সংরক্ষণ করার ব্যাপারে আমাদের সচেতন হতে হবে, অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট। বৃক্ষ রোপণে জাতীয় পুরস্কার স্বর্ণপদক (১ম) প্রাপ্ত।