ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মানুষ কি সত্যিই বৃদ্ধ হয়?

সাঈদ চৌধুরী
মানুষ কি সত্যিই বৃদ্ধ হয়?

খুব বৃদ্ধ মানুষের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখেছেন? কেমন একটা পূর্ণাঙ্গ কবিতা আপনার সামনে দাঁড়ানো, কত কথা তার চোখে, কত জীবনের প্রতিচ্ছবি তার প্রতি পদে পদে। যে ফুল ফুটে গাছেই আবার ঝরে পড়ে, সে ফুলের সবচেয়ে সুন্দর সময়টিতে যদি কেউ তুলে নেয়, তবে যেমন ফুল ফোটার স্বার্থকতা আসে- তেমনি প্রতিটি মানুষ তার সারা জীবনে যতবার ভালোবাসে, ততবার তার স্বার্থকতা আসে। বৃদ্ধ মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকবেন। তাকিয়ে ফিরে যাবেন তার বাল্যকালে। দেখবেন তার শরীরের চামড়াগুলো টান টান ছিল। সেও একসময় তার বাবার জন্য অপেক্ষা করত, আদরে বাঁচত, জীবনকে তার প্রজাপতি মনে হতো।

প্রজাপতির মতো উড়তে উড়তে, সেও একসময় কবিতা হতে চাইত। কারো চোখ, ঠোঁটকে জীবনের মূল্যবান উপাদান মনে হত তার জীবনেও। অপেক্ষাকে মনে হত প্রতিদিনের দিনলিপি। সামান্য কষ্টে মনে হত জীবন কি সত্যিই কিছু দেয় নাকি কেড়ে নেওয়াই তার ধর্ম। নদীর ভাঙন আর জীবন কি তবে একই? নাকি সমতল ভূমির মতো জীবন একই সরল রেখায় বহমান!

এ কিছুর পরও যখন মানুষ কাউকে ভালোবাসতে শুরু করে এবং সে কবিতায় ডুব দেয় তার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় চিন্তা, সংসার, দায়িত্ব আর কাজ। এবার সে আর একা নয়। তার চারপাশে অনেক মানুষ জমা হতে থাকে। সবাই তাকে নিয়ে মেতে থাকে। কিন্তু সেত জানে সে একা হচ্ছে। পাশে দাঁড়ানোর মানুষের চেয়েও মধু নিয়ে পালাবার মানুষ অনেক!

তবু জীবনকে উপভোগ করতে চায়। সন্তান, সঙ্গীকে নিয়ে তার একটি জগৎ আছে, মা বাবাকে নিয়ে তার একটি বড় খেলার মাঠ আছে, আত্মীয় আর সামাজিক অবস্থান নিয়ে তার একটি বিশাল মহাযজ্ঞ আছে!

তারপরও সে জানে বেলা মাথার উপর, এখন শুধু হেলে পড়ার সময়। তার মানে খুব বেশি দিন আর নিজেকে ধরে রাখা যাবে না। সে তখন মাঝে মাঝে বৃদ্ধদের দিকে তাকানো শুরু করে। মাঝেমধ্যে নিজের চেহারায় চামড়া কুচকানো অনুভবে নিজেকে স্পর্শ করে। নিজের বাবা-মাও তখন অনেক বৃদ্ধ হতে শুরু করেছে। কিছুই বুঝতে চায় না তারা; কিন্তু সে মনে করে বোঝে না কেন বাবা-মা, এত বয়সেও কেন এত অবুঝের মতো আচরণ!

মনের ঘুণ আর সময় মানুষের সব কিছু কুচকে দেয়, জড়ো হয়ে যায় হাত পা, ক্ষুধা কমে যায়, রাতে ঘুম আসে না আর যতই চিন্তাহীন থাকতে চায়, ততই যেন চিন্তা পেয়ে বসে তাদের অন্তর কক্ষে! বৃদ্ধ হওয়ার আগে সব পরিবর্তন যদি মানুষ একবার অনুভবে বুঝে ফেলে তবে সে মন থেকেই বৃদ্ধ হয়ে যায়। মনের বার্ধক্য ছড়ায় শরীরে। গলার নিচের চামড়া ভাঁজ হয়ে জানান দেয় কী যেন একটা হচ্ছে, এই টান টান শরীরের ঊর্ধ্ব অংশ থেকে।

কবিতার শেষাংশে এসে নিজের শৈশবকে মনে করতে থাকে মানুষগুলো। বাবার আঙুল, খেলার মাঠে দৌড়ে বেড়ানো, বৃষ্টি হলে মা কঞ্চি হাতে দৌড়ে আসছেন আর আমি দৌড়চ্ছি, সমানে পেছনে মেঘ আর মেঘ, কেউ আমাদের ধরতে পারবে না...! শুধু মা আর আমি বৃষ্টিতে ভিজে একাকার! চিৎকার করে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে উঠে দেখে দেহে আধো বুড়ো আড়ষ্ঠ শরীরে শুধু না পাওয়ার বেদনা!

মধ্যরাতে এপাশ-ওপাশ করে আবার একটু ঘুমের ঘোর। হঠাৎ দেখে স্কুলের বারান্দায় সব বন্ধুরা এক হয়েছে। দৌড়ে তুহিন, রানা, মজিদ, কাজিম এসে বলছে চল স্কুল ছুটি হয়েছে। ঘণ্টা না শুনেই সবাই দৌড়। দৌড় আর দৌড়। আজকে স্যার এলেও আর ফিরব না! কত স্কুল পালানোর স্বপ্ন শেষে আবার চিৎকার দিয়ে উঠে দেখে ভোর হয়েছে। বাজারের ব্যাগ পড়ে আছে কাছে। কী যেন নেই। শরীর কেন যেন কথা শুনতে চায় না। আর শুধুই ফিরতে চায় সেইসব দিনগুলোতে! তারপর এক সময় ভারী কাচের চশমা চোখজুড়ে আবৃত করে রাখে। হিসাবের খাতায় ওঠে কি পেলাম আর কি পেলাম না! কিন্তু সব বুড়ো হলেও চোখটা মানুষের বুড়ো হয় না। চোখ মানুষকে সব আগের মতোই দেখায়। সব সবুজ, সব যৌবনের রঙে ভরা জীবনের গল্প আর মানুষের অভিনয়!

যখন সব কিছু একটা চোখ আগের মতোই দেখে; কিন্তু যে দেখছে তাকে অন্যজনে বৃদ্ধ মনে করে দেখে এ বিষয়টি মানুষ মেনে নিতে পারে না এবং মেনে নিতে চায়ও না! এ যেন এক জীবনের বড় পরীক্ষা, জীবন চলার পথে বড় ব্যত্যয় কোনো মানুষই অবহেলা নিতে চায় না।

এজন্য বৃদ্ধ মানুষকে কেউ তাচ্ছিল্য করলে বা সময় দিতে না চাইলে তখন তাদের মন সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়। বৃদ্ধ মানুষের দিকে তাকাবেন, তাদের সময় দেবেন, একটু বেশি করে কথা বলবেন।

তার সারা জীবনে সে যে পুরো একটি কবিতা হয়ে উঠেছে তা নিয়ে ভাববেন। তার সঙ্গে মধ্য জীবনে তিনি যেমন ছিলেন ওটা ভেবে কথা বলবেন। মানুষ কখনো বৃদ্ধ হয় না। শরীরে মাটির অংশটুকু ঝুরঝুরে হয়ে যায়, পৃথিবী তার পানি টেনে নিয়ে প্রতিশোধ নেয়। পৃথিবী থেকে যে মাটি নিয়ে মানুষকে তৈরি করা হয়েছিল, সে মাটির টানে আবার মানুষ মাটিতে ফিরে যায়। তাই বৃদ্ধ মানুষদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই, মাটিকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্যই শ্রদ্ধা করুন, সম্মান দিন এবং তাদের সময় দিন। বিশেষ করে বৃদ্ধ বাবা-মাকে নিয়ে আপনারা সময় অতিবাহিত করুন। তারা চায় আপনি তার পাশে কিছুক্ষণ বসে থাকুন, তাদের হাত ধরে ছোটবেলার মতো এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ান। তারা যদি প্রাপ্য সম্মানটুকু পায় তবে তারা ভাবেন জীবন স্বার্থক হয়েছে। এই স্বার্থকতা তাদের বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করে এবং এটাই উচিত। মানুষ বৃদ্ধ হয় না শুধু সময় তাকে আটকে দেয় কোনো জালে!

সাঈদ চৌধুরী : কলাম

লেখক ও সাহিত্যিক

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত