ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রযুক্তির যুগে নতুন জীবন

রহমান মৃধা
প্রযুক্তির যুগে নতুন জীবন

কিছুদিন আগে সুইডেনের একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ভদ্রমহিলা ৭০ বছর পার করলেন। ভদ্রমহিলার নাম এভা। এভার তিন মেয়ে এক ছেলে। স্বামীর নাম জোহানেস এবং তার জন্মস্থান জার্মানির বার্লিনে। জোহানেস এবং এভার পরিচয় ঘটে ১৯৭৬ সালে ইন্ডিয়া ভ্রমণে এবং পরে দু’জন ভালোবেসে বিয়ে করেন ১৯৭৭ সালে স্টকহোমের অদুরে টুম্বা নামে একটি গ্রামে। এভা এবং জোহানেস একসঙ্গে বসবাস করছেন ৪৬ বছর ধরে। এভা এবং জোহানেস দুইজনই চিত্রশিল্পী। এদের লাইফ স্টাইল ভিন্ন অন্যান্য সুইডিশ পরিবারের থেকে। এরা শহর ছেড়ে গ্রামে অতি সাধারণভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এদের চার ছেলেমেয়ে সুইডিশ প্রাইমারি স্কুল শেষ করেই বিয়ে করেছে। সুইডেনে ক্লাস নাইন পাস করতেই হবে, তারপর জোর জুলুমের কিছু নেই, ক্লাস নাইন পাস করার পর এরা কাজ করতে পারে, লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। তবে ১৮ বছরের আগে নিজ দায়িত্বে বিয়ে করার নিয়ম নেই; কিন্তু বাবা-মার অনুমতিতে ছেলেমেয়ের একসঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ রয়েছে।

এমতাবস্থায়, যদি সন্তানের জন্ম হয় তাতেও কোনো বাধা নেই। এভার বড় মেয়ে থাকে সুইজারল্যান্ডে, মেজো মেয়ে ফ্রান্সে এবং ছোট মেয়ে স্টকহোমে। এভার জন্ম দিনে ছোট মেয়ে রাধিকা তার চার ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছে। রাধিকার বয়স ৩৬ বছর হলেও দেখে কোনোভাবেই সেটি মনে হবে না। যদিও তার বড় ছেলের বয়স ১৮ বছর। মাসহ তিন ছেলে এক মেয়েকে দেখে মনে হলো তারা পাঁচ ভাইবোন। রাধিকার ছোট ছেলের বয়স যখন তিন বছর, তখন সে হাইস্কুল এবং কলেজ শেষ করে রীতিমতো ডাক্তারি পাস করে গত তিন বছর ধরে ফুল টাইম চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত। আমি রাধিকার সঙ্গে নানা বিষয়ের ওপর কথা বলে অনেক তথ্য জানতে পারলাম। রাধিকার যে জিনিসটা আমার বেশি ভালো লেগেছে, সেটি হলো তার কাজে শতভাগ মনোযোগী হওয়ার সুযোগ। রাধিকা বলল, তাকে ছুটি নেওয়া লাগে না বাচ্চা অসুস্থ হলে, কারণ সবাই এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। মনের আনন্দে কাজ করা, কোথাও যাওয়া বা কিছু করা কোনো চাপ সৃষ্টি করে না তাকে। রাধিকা যখন যেটি করার সময় সেটি তখন করতে পেরেছে, যার ফলে জীবনের চাওয়া পাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন অন্যান্যদের থেকে। এটি আমাকে বেশ ভাবিয়েছে মূলত সে কারণেই আমার এ লেখা।

ইউরোপের নতুন ট্রেন্ড দেখে মনে হচ্ছে নতুন প্রজন্ম জীবনকে শুরু থেকেই উপভোগ করতে চেষ্টা করছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং লেখাপড়া ছাড়াও যে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সেগুলোর প্রতি বেশি নজর দিচ্ছে। অনেকে দেখা যাচ্ছে- কলেজ শেষ করে কয়েক বছর যে কোনো কাজে যোগ দিয়ে অর্থ উপার্জনে সময় দিচ্ছে, পরে বিশ্বভ্রমণ করছে। শেষে বিয়ে করে নতুন করে মন চাইলে পড়াশোনা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। কে কী ভাবছে, সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং নিজে কী চায় সেটির ওপর গুরুত্ব বেশি দিচ্ছে যা সত্যিই কিছুটা ভিন্ন আমাদের সমাজের থেকে। আমাদের দেশে চাকরিতে বয়সসীমা একটি বিষয় যা অনেককে ভীষণ চিন্তার মধ্যে ফেলে, তারপর সামাজিক জীবনের দায়ভার রাষ্ট্র নিতে পারছে না। এই দায়িত্ব নেওয়ার মতো সামর্থ্য রাষ্ট্রের নেই, সেটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সব মিলে ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। তারপরও আমি এতটুকু বলতে চাই সেটি হলো তাড়াহুড়ো করে জীবনের ১২টা না বাজিয়ে বরং যখন যেটি করার কথা, সেটি করার মনমানসিকতা গড়ে তুলুন। ছোটবেলার সখ বড় হয়ে বা অর্থনৈতিক সামর্থ্য হলে শত চেষ্টা করলেও পূরণ করা সম্ভব নয়, এটি মনে রাখা দরকার। যেমন, কৈশোর বা যৌবনের প্রেম বৃদ্ধকালে করলে, শত চেষ্টা করলেও তৃপ্তিটা কৈশোর বা যৌবনের মতো হবে না। সে ক্ষেত্রে সঠিক প্রেমের সময় সঠিক প্রেম করুন। সর্বোপরি প্রযুক্তির যুগে শিক্ষার জন্য বদ্ধ ঘরে বন্দি হওয়ার কোনো কারণ নেই। স্কুলে যা শিক্ষা দেওয়া হয় তার সবকিছুই প্রযুক্তির যুগে ইচ্ছে করলে স্কুলের বাইরে থেকেও জানা সম্ভব। তার জন্য শুধু দরকার মোটিভেশন এবং ডেডিকেশন। নিজেকে জানতে অন্যের কাছে প্রশ্ন না করে নিজেকে বরং নিজেই প্রশ্ন করতে শিখুন, দেখবেন আপনার শিক্ষা সু এবং সৃজনশীল হবে। কারণ বই পড়ে কেউ কি ফুটবল খেলা শিখতে পারে? না। তা ছাড়া পুঁথিগত শিক্ষা, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য গঠন বা গ্রেড অর্জন করা আর একটি চরিত্র গঠন করা কিন্তু এক নয়।

সংযম, সাহস, সৌজন্য, বিচক্ষণতা, ন্যায্যতা, বন্ধুত্ব, উদারতা, ভদ্রতা, সহায়তা, সততা, নম্রতা, দয়া, বাধ্যতা, শৃঙ্খলা, ধৈর্য, অধ্যবসায়, আত্মনিয়ন্ত্রণ, কৌশলতা, প্রজ্ঞা, এই জিনিসগুলো কে শেখায়? মা-বাবা, শিক্ষক, সমাজ এবং পরিবেশ। তবে এর প্রকাশ কিন্তু ঘটে আপনার নিজের মধ্যে। শুধু তোতা পাখির মতো সব মুখস্থ থাকলে হবে না-এর বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষা গ্রহণ করা মানে কাজে ব্যর্থ হওয়া। আর আপনার অভিজ্ঞতার গভীরতাই আপনার কার্যকলাপের প্রভাব-পূর্ণতা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত