ব্রেইল পদ্ধতিতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষার আলো

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ : ০৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্ব ব্রেইল দিবস পালিত হলো ৪ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার। দিবসটি অন্ধ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদের শিক্ষার সুযোগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। আর তারা এই শিক্ষা গ্রহণ করছে যে পদ্ধতিতে সেটিকে আমরা ব্রেইল পদ্ধতি বলি। ব্রেইল পদ্ধতি আবিষ্কারের ফলে অন্ধ ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা শিক্ষার সুযোগ পেয়েছে। তারাও প্রমাণ করতে পারছে তাদের মেধা এবং দক্ষতা। ব্রেইল পদ্ধতি আবিষ্কার করেন লুইস ব্রেইল। ১৮০৯ সালের ৪ জানুয়ারি প্যারিসের কাছে কুপভেরি নামক একটি ছোট্ট শহরে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার এই মহান সুদূরপ্রসারী আবিষ্কারের ফলে তাকে সম্মান জানানোর জন্য তার জন্মদিনে ব্রেইল দিবস পালিত হয়। ব্রেইল পদ্ধতিতে ছয়টি ডট দিয়ে অক্ষর, সংখ্যা, চিহ্ন ইত্যাদিকে সূচিত করা হয়। দৃষ্টিহীন ব্যক্তিরা এই উন্নীত বা উত্তর বিন্দুর ওপর আঙুল বুলিয়ে নকশা অনুযায়ী অক্ষরগুলো অনুধাবন করে। এই পদ্ধতি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য যে কতটা আশীর্বাদস্বরূপ সেটি আমরা সাধারণ মানুষ হয়তো উপলব্ধি করতে পারি না। এই পদ্ধতিতে পৃষ্ঠার উপরে সাজানো কিছু ডট বা বিন্দু হাত দিয়ে ধরে ধরে অন্ধ ব্যক্তি বুঝতে পারেন, কী লেখা আছে। সুপার মার্কেটের বিভিন্ন পণ্যের গায়ে, এটিএম বুথের কি- প্যাডে বা এ রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জায়গায় ব্রেইল অক্ষর বা সেল চোখে পড়ে। ১৮০০ শতকের কথা। ফ্রেঞ্চ আর্টিলারি অফিসার চার্লস বারবিয়ের শুধু ১২টি বিন্দু বারবার ব্যবহার করে তথ্য আদান-প্রদানের একটা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। মানে, ১২টা বিন্দুকে বিভিন্ন বিন্যাসে সাজিয়ে প্রতিটি অক্ষর বা সংখ্যা লেখা যাবে। এর নাম ছিল ‘নাইট রাইটিং’। রাতের অন্ধকারে বাতি না জেলেই সৈন্যরা যেন তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। কিন্তু এই পদ্ধতির একটা বড় সমস্যা ছিল। ১২টা বিন্দু একই সঙ্গে ধরে অনুভব করাটা বেশ কঠিন। তা ছাড়া এ ক্ষেত্রে বিন্দুগুলোর বিন্যাসের পরিমাণও অনেক বেড়ে যায়। এই সমস্যার সমাধান করে ১২ বছর বয়সি এক কিশোরঙ্গুইস ব্রেইল। তার নামেই বর্তমানে এই পদ্ধতিটিকে ব্রেইল পদ্ধতি বলা হয়। প্যারিসের রয়্যাল ইনস্টিটিউট ফর ব্লাইন্ড ইউথসে বারবিয়ের অন্ধদের জন্য ‘নাইট রাইটিং’ পদ্ধতি ব্যবহারের উপযোগিতা নিয়ে কথা বলেন। ব্রেইল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভাবলেন, প্রতিটি অক্ষরকে ১২টির বদলে ছয়টি বিন্দু দিয়েই কি প্রকাশ করা সম্ভব? যেই ভাবা, সে-ই কাজ। ছয়টি বিন্দুকে দুটি কলাম এবং তিনটি সারিতে বিন্যস্ত করলেন ব্রেইল। এদের ‘সেল’ বলা হয়। তারপর বিভিন্ন অক্ষর বা সংখ্যার জন্য বিন্দুগুলোকে বিভিন্ন বিন্যাসে বিন্যস্ত করলেন। যেমন ইংরেজি বোঝানোর জন্য ছয় বিন্দুর সেলের একেবারে বাঁয়ের বিন্দুটি শুধু উঁচু হয়ে থাকবে। স্বাভাবিক ইংরেজি বাক্যের মতোই, ব্রেইল পদ্ধতিতেও প্রতিটি অক্ষর বা সেলকে আলাদা করে যেমন পড়া যায়, তেমনি কয়েকটি সেল একসঙ্গে মিলে তৈরি করতে পারে শব্দ। দুটো শব্দের মধ্যে কিছুটা ফাঁকা থাকে, যাতে বোঝা যায়, দুটো শব্দ আলাদা।

ব্রেইল লেখার জন্য মোটা কাগজে সরু মাথার কিছু দিয়ে দাবিয়ে দাবিয়ে লিখতে হয়। সমস্যা হলো, লেখাটি লিখতে হয় উল্টো করে। কারণ, পড়ার সময় কোনো বিন্দুটা উঠে আছে, সেটা ধরে বোঝা লাগে। তাই উল্টো করে লিখে পৃষ্ঠা উল্টে দিলে লেখাটি পড়ার যোগ্য হয়। এখন এভাবে হাতে হাতে আর লেখা হয় না। বই ভিন্ন যন্ত্রপাতি বা ব্রেইলরাইটার দিয়ে লেখা হয়। ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা বইও বাজারে পাওয়া যায়। তবে আর সবকিছুর মতোই ব্রেইলের জগতেও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। প্রযুক্তির ওপরে ভর করে কাগজের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকের যন্ত্র। এর নাম রিফ্রেশেবল ব্রেইল। এগুলো আসলে বৈদ্যুতিক ব্রেইল রিডার। ডিজিটাল টেক্সট বা লেখা পড়ে নিয়ে তাকে ব্রেইলে রূপান্তর করে যন্ত্রটি। তারপর যন্ত্রের একপাশের সারিবদ্ধ সেলগুলোতে ব্রেইল অক্ষরে ফুটে উঠতে থাকে লেখাটি। এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, একসঙ্গে শুধু এক লাইন লেখাই সে দেখাতে পারে। আর, এদের দামও অনেক বেশি। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক ব্রেইল ট্যাবলেট বানানোর জন্য কাজ করছেন। এর মধ্যকার সেলগুলোতে বিভিন্ন বর্ণ দেখানোর জন্য বাতাসকে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন তারা। বাতাসের পরিমাণ কম-বেশির মাধ্যমে সেলের মধ্যকার বর্ণগুলো পরিবর্তিত হবে। প্রজেক্টটির নাম দেওয়া হয়েছে হলি ব্রেইল! ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের তথ্যমতে, পৃথিবীতে বর্তমানে ৩৬ মিলিয়ন অন্ধ মানুষ আছেন। সে তুলনায় খুব বেশি মানুষ ব্রেইল ব্যবহার করেন না। বর্তমানে বেশির ভাগ জায়গায় ব্রেইলের বিকল্প হিসেবে অডিও ব্যবহার করা হয়। মানুষ তার নিজের জীবন থেকেই কোনো কিছুর গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি করে লুইস ব্রেইলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তিন বছর বয়সে লুইস ব্রেইল অন্ধ হয়ে যান। দৃষ্টিহীনতার কারণে তার জীবন থেমে থাকেনি। পড়াশোনার জন্য তিনি ভর্তি হলেন প্যারিসের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য তৈরি বিশেষ স্কুলে। একদিন তিনি জানতে পারলেন অ্যালফাবেট কোডের কথা। ফরাসি সৈন্য বাহিনীর অফিসাররা সৈন্যদের সঙ্গে রাতে কথা বলার সময় শত্রুপক্ষের নিশানা থেকে বাঁচতে এই কোডে কথা বলতেন। এই অ্যালফাবেট কোড বেশ কিছু বিন্দু আর ছোট লাইনের সমষ্টি যেগুলো পাতার ওপর একটু উঁচু করে খোদাই করা হতো যাতে আঙুল স্পর্শ করলে সেগুলো পড়া যায়। ব্রেইলের কাছে এই পদ্ধতি অনেক ভালো লাগে এবং তার মাথায় অন্ধদের জন্য শিক্ষা দেওয়ার নতুন উপায় আসে। ২০ বছর বয়সে অন্যান্য অন্ধ ব্যক্তিকে তিনি শিক্ষা দিতে অগ্রসর হন।

১৮২৭ সালে তিনি প্রথম ব্রেইল পদ্ধতির বই প্রকাশ করেন। তবে তখনকার সময়ে এই পদ্ধতিতে অন্ধদের শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারটি খুব একটা প্রচলিত হয়নি।