কর্ণফুলী টানেল বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়

প্রদীপ সাহা

প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দেশের সড়ক যোগাযোগে নতুন এক যুগের সূচনা করেছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম বহুলেন সড়ক টানেল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ অক্টোবর ২০২৩-এ টানেলটি উদ্বোধন করেন। এটির নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ বা সংক্ষেপে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’। দক্ষিণ এশিয়ায় নদীর তলদেশ দিয়ে যানবাহন চলাচলকারী প্রথম টানেল এটি। সরকারের মেগাপ্রকল্পগুলোর মধ্যে এটি একটি। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটিতে চীন ও বাংলাদেশ যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে। বেইজিং দুই শতাংশ সুদে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। কর্ণফুলীর তলদেশে ১৮ থেকে ৩১ মিটার গভীরতায় চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি টানেলটি তৈরি করেছে। মূল টানেলটি ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১০ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থ। প্রতিটি টিউবে দুটি লেনসহ এর দুটি টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্তে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক ও আনোয়ারা প্রান্তে ৭২৭ মিটার ফ্লাইওভার আছে। দেশে সাম্প্রতিককালে অনেকগুলো বৃহৎ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে যে কোনো প্রকল্পের ভিড়ে নদীর তলদেশে নির্মিত টানেল বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়।

নদীর তলদেশ থেকে টানেলের সর্বোচ্চ গভীরতা ৩১ মিটার। টানেলে আছে বিপরীতমুখী দুটি টিউব। প্রতিটি টিউবে দুটি করে মোট চারটি লেন আছে। দুই লেনের ডুয়েল টানেলের প্রবেশপথ চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ও সমুদ্রবন্দরের কাছে, কর্ণফুলী নদীর ভাটির দিকে নেভি কলেজের কাছে।

আর বহির্গমন হলো আনোয়ারা উপজেলার প্রান্তে সার কারখানার কাছে। এ টানেলটি মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিশাল ভূখণ্ডকে অর্থনৈতিক করিডোরে রূপান্তরিত করবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদ ও বিনিয়োগকারীরা। ২০১৬ সালের অক্টোবর টানেলটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি। ২০২০ সালের নভেম্বরে উদ্বোধনের কথা থাকলেও কোভিড-১৯ মহামারিসহ কয়েক দফায় তা পিছিয়ে যায়; সঙ্গে বাড়ে ব্যয়ও। প্রাথমিকভাবে যেটি সাড়ে ৮ হাজার কোটির কিছুটা কম ছিল, তা বেড়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭১ লাখ টাকা। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যয় করছে ৪ হাজার ৬১৯ কোটি ৭০ লাখ এবং চীনের ঋণ ৬ হাজার ৭০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চট্টগ্রাম শহরে নিরবচ্ছিন্ন ও যুগোপযোগী সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং বিদ্যমান সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে এ প্রকল্পটি করা হয়েছে। এ মুহূর্তে চট্টগ্রাম থেকে আনোয়ারার তুলনামূলক ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়েছে। একই সঙ্গে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে নতুন সড়ক যোগাযোগের কাজে আসবে এ টানেল। বিদ্যমান কর্ণফুলী নদীর ওপরের দুই সেতুতে চাপ কমাতেও সাহায্য করবে এ টানেল। যেমন এ টানেলটি বর্তমান কোরিয়ান ইপিজেডের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের যাতায়াতের তুলনামূলক সুবিধাজনক রুট হবে। এছাড়া ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ৫০ কিলোমিটারের মতো দূরত্ব কমবে এবং সময় বাঁচবে এক ঘণ্টার মতো। ভবিষ্যতে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হবে টানেলের মধ্য দিয়ে। প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা দাবি করছেন, এ টানেল নির্মাণের আরেকটি উদ্দেশ্য হলো চট্টগ্রাম শহরকে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ অর্থাৎ ‘এক নগর দুই শহর’-এর মডেলে গড়ে তোলা। যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুর পর শহরের সম্প্রসারণ ও বিদ্যমান শিল্প নগরীর আরও শিল্পায়ন হওয়ার চিন্তা থেকেই এমনটা বলা হচ্ছে।

কর্ণফুলী নদীর পূর্বদিকের প্রস্তাবিত শিল্প এলাকায় যেমন উন্নয়নের দিক আছে, তেমনি পশ্চিম দিকের শহর-বন্দর ও বিমানবন্দরের সঙ্গে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া নদীর পূর্ব প্রান্তে ভবিষ্যতে শিল্পায়নের দিক ছাড়াও পর্যটন শিল্পের বিকাশের কথা বলা হচ্ছে। তবে টানেলের কার্যকারিতার বড় অংশই দুই পাশের ব্যবস্থাপনার অনেক দিকের ওপর নির্ভর করবে। মহাসড়কের অব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সময় বাঁচানো যাবে না। প্রকল্পের বাইরে উভয় দিকের রাস্তা ছোট এবং যানজটের সমস্যা প্রকট। রিকশা-টেম্পোর মতো কম গতির বাহন মহাসড়কে চলাচলের কারণে বিশৃঙ্খলা বা দুর্ঘটনার মতো ঘটনা ঘটে। যদি ঢাকা-কক্সবাজার রুটেও এমন চলতে থাকে, তবে বিভিন্ন জায়গায় ‘বটলনেক’ দেওয়া যেতে পারে। এতে যানবাহনের গতি কমে যাবে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কোন ধরনের গাড়ি চালালে অল্প জায়গায়, অল্প সময়ে সর্বোচ্চ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে- এসব বিষয় চিন্তা না করে শুধু পরিকল্পনা করলে সুফল পাওয়া যাবে না বলে জানান বিশেষজ্ঞমহল।

কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে কাজ করেছে চীনের ‘চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি’। এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ সেই কোম্পানির সঙ্গে পাঁচ বছরের চুক্তি করেছে। তবে এ টানেলটি খুবই ‘সংবেদনশীল’ এবং এর রক্ষণাবেক্ষণ খুব সহজ হবে না বলে মত দিয়েছেন অনেকেই।

এখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ যেমন নিশ্চিত করতে হবে, তেমনি প্রতিদিন কার্বন-ডাই-অক্সাইড অপসারণ করে অক্সিজেন প্রবেশ করাতে হবে। এছাড়া টানেলে যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তবে সেটিকে উদ্ধারের খরচটিও মাথায় রাখতে হবে। টানেলের প্রকল্পের ভেতরেই ‘সার্ভিস এরিয়া’ বলতে একটি বিশেষ অংশের কাজ চলছে।

সেখানে থাকবে ৩০টি বাংলো, একটি ভিআইপি বাংলো, মোটেল মেস, হেলথ সেন্টার, মাঠ, টেনিস কোর্ট, কনভেনশন সেন্টার, জাদুঘর, সুইমিং পুল, মসজিদ, হেলিপ্যাডসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা। এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজারের মধ্যে একটি নতুন সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলাই হচ্ছে এ টানেলটির লক্ষ্য। চট্টগ্রাম বন্দরের সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে এবং প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজ ত্বরান্বিত করতে এ টানেলটি বিরাট ভূমিকা রাখবে।