পানি দূষণ রোধে বাড়াতে হবে জনসচেতনতা

নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার

প্রকাশ : ০৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

পানির অপর নাম জীবন এটি আমরা সবাই জানি। তবে বর্তমানে পানির সঙ্গে আরেকটি বিষয় যুক্ত হয়েছে তা হলো সুপেয় পানি। আমাদের ব্যবহারের পানি অযোগ্য হয়ে পড়ছে দিন দিন। বিশেষ করে আমাদের মতো জনসংখ্যাবহুল দেশের জন্য অতি চিন্তার বিষয়। সমসাময়িক বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিবস বিশ্ব পানি দিবস। যে বিষয়টি সম্পর্কে এত বেশি আলোচনা না হলেও বর্তমান বিশ্বে গুরুত্ব বিচেনায় প্রথম সারির বিষয়। প্রচারণা ও কার্যক্রমের দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে এদিবসটি এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ দিবসটির তাৎপর্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সকলেই জড়িত। কিন্তু এটি যেহেতু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনামূল্যে পাচ্ছি, তাই এ নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয় না।

উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে জাতিসংঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্মেলনে প্রথম বিশ্ব জল দিবস পালনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব উত্থাপন হয়। পরে ১৯৯৩ সালে প্রথম পানির গুরুত্বকে তুলে ধরার জন্য জাতিসংঘ ২২ মার্চকে বিশ্ব পানি দিবস হিসেবে ঘোষণা করে তারপর থেকে দিবসটি পালনের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলো এই দিনটিকে নিজ নিজ দেশে জাতিসংঘের জলসম্পদ সংক্রান্ত সুপারিশ ও উন্নয়ন প্রস্তাবগুলোর প্রতি মনোনিবেশের দিন হিসেবে উৎসর্গ করেন। সরকার জল সম্পদকে রক্ষা করার জন্য এদিবসটিতে বিশেষ বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনগণকে এ বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করা হয়। তবে মূল বিষয় হলো- পানি সম্পদ রক্ষা করার জন্য এ দিবসে যে পরিমাণ গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন আমার মনে হয়, তার তেমন কিছুই করা হয় না। এ দিবসটি বর্তমানে যে গুরুত্ব বহন করছে, সে পরিমাণ কার্যক্রম দিবসটিতে দেখা যায় না। পানি হচ্ছে অমূল্য সম্পদ প্রাণিকূলকে রক্ষা করতে হলে পানিকে দূষণমুক্ত রাখার কোনো বিকল্প নেই। প্রতিবছরই বিশ্ব পানি দিবসে সবচেয়ে বড় অঙ্গীকার হওয়া উচিত পানির সঠিক ব্যবহার। পানি দূষণ বলতে পানির গঠনগত এবং অবস্থানগত এমন পরিবর্তনকে বুঝায় যাতে পানি স্বাভাবিক অবস্থায় জীবজগতের যেসব কাজে বা উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হতো সেসব কাজের জন্য অনুপযোগী থাকে এবং জীবন রক্ষার চেয়ে জীবনকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। পানি দূষণের বিষয়টি শুধু এখন আর আমাদের দেশে নয়। সারা পৃথিবীতেই পানি হয়ে উঠেছে অনিরাপদ। সবাই মুখে বললেও এর জন্য কার্যকরি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। সবার অবস্থানটা এরকম যে এ সমস্যাটা কেবলই নিজের। এই সমস্যা সমাধান করতে হলে এর সঠিক কারণ আগে খুঁজে বের করে এগুলোর সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে কারণ জানা থাকলেও এসব কারণ সমাধানের খুব একটা চেষ্টা করা হচ্ছে না বলেই মনে হয়। পৃথিবীর মানুষ বৃদ্ধি এবং শিল্প কারখানাসহ উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়তই বাড়ছে পানির চাহিদা। কিন্তু বাড়ছে না সুপেয় পানির পরিমাণ। সমুদ্র, নদীনালা ও হ্রদ আমাদের পানির যোগানের অন্যতম উৎস। কিন্তু এসব উৎসকে আমরা এমনভাবে ব্যবহার করছি যে ভবিষ্যতে আমাদের আর পানি দরকার হবে না বলে মনে হয়। স্পেস ব্লগ সাইট থেকে জানা যায় ভূপৃষ্ঠের প্রায় ৭০ শতাংশজুড়ে জল দ্বারা আবৃত। গ্রহের মোট জলের মধ্যে ৯৭ শতাংশ সমুদ্র এবং মহাসাগরের এবং মাত্র তিন শতাংশ স্বাদু জল। এর মধ্যে আবার দুই শতাংশ কঠিন আকারে এবং এক শতাংশ এরও কম ব্যবহারের জন্য। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় নিম্নের বিষয়গুলোর কারণে পানি দূষিত হচ্ছে দ্রুত। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, পয়ঃপ্রণালির আবর্জনা, শিল্পের আবর্জনা, মানুষ দ্বারা প্রত্যক্ষ দূষণ, কঠিন আবর্জনা, কীটনাশক ও আগাছানাশক ওষুধ, তেজষ্ক্রিয় পদার্থ, এসিড, খনিজ তেল দূষণের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ করে পয়ঃপ্রণালির ক্ষতিটা হচ্ছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বেশি। মলমূত্র ও বর্জ্য পদার্থ নদীতে গিয়ে এমনভাবে পড়ছে যার ফলে ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে অজৈব পদার্থে পরিণত হচ্ছে পানি। এর ফলে ক্রমান্বয়ে নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। ফলে জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদ মারা যাচ্ছে ও বিষাক্ত গ্যাসের সৃষ্টি হয়। ইদানিং শিল্পকারখানার উত্তপ্ত বর্জ্য পদার্থ পানিতে নির্গত হওয়ার ফলে পানির তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে পানির অক্সিজেন ধারণক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শিল্পকারখানা হতে নির্গত বিষাক্ত আর্সেনিক পানিতে মিশে থাকে। এসব ক্ষতিকর উপাদান পানিকে দূষিত করছে। এ ছাড়া মানুষ প্রত্যক্ষভাবে পানিতে গোসল ও বস্ত্রাদি ধৌত করার ফলে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ পানিতে মিশে পানির ক্ষতি করছে। অন্যদিকে পলিথিন, রাবার, প্লাস্টিক দ্বারা তৈরি পণ্য যা সহজেই নষ্ট হয় না এগুলো পানিতে জমে পানিকে নষ্ট করছে। কৃষিপ্রধান দেশে আমাদের চাহিদা মেটানোর লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত উৎপাদন বৃদ্ধির চিন্তা করতে হচ্ছে। আর এই উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহার করছে কৃষক আর এসব ওষুধ মাটির সঙ্গে থাকা পানিতে মিশে যাচ্ছে এবং এই পানি জলাশয়ে গিয়ে পতিত হচ্ছে যার ফলে দূষিত হচ্ছে পানি। বর্তমানে বিশ্বে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে গাড়ির ব্যবহার ও আণবিক শক্তি সরবরাহের জন্য বিভিন্ন পরমাণু ও তেজস্ক্রিয় আইটোসেপের ব্যবহার। এসব পদার্থগুলো বৃষ্টির পানিতে মিশে পানির উৎসগুলোতে পতিত হচ্ছে যার ফলে পানি হচ্ছে ব্যবহারের অযোগ্য। প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে আমরা এই প্রাকৃতিক সম্পদকে বিনষ্ট করছি; কিন্তু এ থেকে মুক্তির উপায় আমরা বের করছি না বের করলে এ লক্ষে কাজ করছি না। এ অবস্থা থেকে মুক্তির যেসব উপায় রয়েছে তার জন্যও যথেষ্ট চেষ্টা করছি না। যেসব কারণে আমাদের এ মহামূল্যবান পানি নষ্ট হচ্ছে এবং এর ফলাফল কী হচ্ছে তার দিকেও আমাদের কোনো চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। কেবলমাত্র এ দিবসটিতে একটি ব্যানার টানিয়ে সচেতনতার বৃথাই চেষ্টা করে যাচ্ছি।

মনে রাখতে হবে আমাদের জীবনধারণের জন্য এটি একটি অত্যাবশকীয় উপাদান। সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে সুপেয় পানির কোনো বিকল্প নেই তাই পানির সঠিক ব্যবহার, সংরক্ষণ এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা অতীব জরুরি। সারা বছর এ বিষয় নিয়ে আমাদের মাঝে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি অন্ততপক্ষে বিশ্ব পানি দিবসে পানি দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। পানির এ দূষণ রোধ করতে না পারলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমরা একটি অনিরাপদ পৃথিবী রেখে যেতে হবে। যত সামনের দিকে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি দূষণের ভয়াবহতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে এ সমস্যাটাকে আমরা কখনো নিজের মনে করছি না। তাই এর দূষেণের মাত্রা কমানোর জন্য সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। পৃথিবীর পানি নিরাপদ রাখার জন্য এককভাবে প্রচেষ্টায় সঠিক ফল না আসাই স্বাভাবিক। তাই এর জন্য বিশ্বব্যাপী একটি সঠিক আইন তৈরি এবং এই আইনের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে পানিকে নিরাপদ রেখে একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবী তৈরি করাই আমাদের অঙ্গীকার হওয়া উচিত। এই ক্ষেত্রে বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উচিত এটিকে কোনো নির্দিষ্ট দেশের সমস্যা হিসেবে বিবেচনা না করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সারা পৃথিবীর সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা এবং বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে কার্যকরি ভূমিকা গ্রহণ করা।

লেখক : শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী।