ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় বিস্মৃত অঙ্গীকার

পাভেল পার্থ
প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় বিস্মৃত অঙ্গীকার

মেঘ ও রোদ্দুর মাথায় নিয়ে এক সময় ঘুরে বেড়াতাম পাথারিয়া থেকে রাজকান্দি হয়ে কালেঙ্গা বন। কালেঞ্জি পাহাড়ে খাসি কবিরাজ নসিফ পথমি একদিন এক মায়াবী কচুগাছ দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দেন।

কচুটির খাসি নাম নিয়াংসোয়াত। খাসি ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায় এটি ব্যবহৃত হয়। কচুটি প্রথম খুঁজে পাই ২০০০ সালে। পরে ২০০৫ সালে বিখ্যাত কচু বিশেষজ্ঞ হোসনে আরা, উদ্ভিদবিজ্ঞানী আবুল হোসেন ও আমি কচুটিকে ‘এগালোনেমা মডেস্টাম’ হিসেবে শনাক্ত করে দেশে প্রথমবারের মতো নথিভুক্ত করি। কিন্তু নিদারুণ বিষয় হলো, কচুটিকে বুনো পরিবেশে পরে খুব কম খুঁজে পাওয়া গেছে। হারিয়ে গেছে কি না জানি না।

করোনাকালে লাউয়াছড়া থেকে হারিয়ে গেল জানামতে দেশের সর্বশেষ আফ্রিকান টিক ওক গাছটি। চোখের সামনে একের পর এক প্রশ্নহীনভাবে বহু প্রজাতির হারিয়ে যাওয়া শরীর ও মনে নিদারুণ দাগ রেখে যায়। রেখে যায় ক্ষত ও ক্ষরণ।

সম্প্রতি আইইউসিএন দেশে বিলুপ্ত ও বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের লাল তালিকা করেছে। দেশের চার সহস্রাধিক উদ্ভিদ প্রজাতির ভেতর থেকে এক হাজার প্রজাতি নিয়ে এই জরিপ করা হয়েছে।

জরিপে দেখা যায়, ৩৯ শতাংশ উদ্ভিদই বিপদাপন্ন। এর ভেতর সাতটি বিলুপ্ত, পাঁচটি মহাবিপন্ন, ১২৭টি বিপন্ন, ২৬২টি সংকটাপন্ন, ৬৯টি প্রায় সংকটাপন্ন, ২৭১টি প্রকৃতিতে টিকে আছে এবং ২৫৮টি প্রজাতির ক্ষেত্রে তথ্য ঘাটতি আছে।

ফিতা চাঁপা, কুড়াজিরি, ভানু দেয়পাত, গোলা অঞ্জন, সাত সারিলা, থার্মা জাম ও মাইটোসিস উদ্ভিদ প্রজাতিকে দেশ থেকে বিলুপ্ত হিসেবে দেখিয়েছে উল্লিখিত জরিপ। বাঁশপাতা, বনখেজুর, বালবোরপ, লম্বা ট্রায়াস অর্কিড ও বলগাছ মহাবিপন্ন।

কেবল প্রাকৃতিক বনভূমি বা গ্রামীণ বন নয়, নগরের শেষ সবুজ বলয় আর সড়কে উন্নয়নের নামে যেভাবে গাছ হত্যা শুরু হয়েছে, তাতে আগামীতে উদ্ভিদের কতগুলো প্রজাতি টিকে থাকবে, তা আন্দাজ করা মুশকিল। কেবল উদ্ভিদ নয়, বন্যপ্রাণীর বেঁচে থাকাও আজ বেসামাল হয়ে পড়েছে। খুদে মৌমাছি থেকে বৃহৎ হাতি, এমনকি তিমিও আজ নিখোঁজ হচ্ছে বেশুমার। করোনা মহামারির প্রথম বছর যখন আমরা লকডাউনে আটকা পড়ি তখন তিন মাসে দেশে বন্যপ্রাণী খুনের একটা হিসাব করেছিলাম।

মূলত দৈনিক ও অনলাইনে প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে এবং কিছু তথ্য নিয়েছিলাম বন্যপ্রাণী নিয়ে কর্মরত কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী দল ও পরিচিতজনের কাছ থেকে। দেখতে পাই, ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্তের পর থেকে মধ্য জুন পর্যন্ত বাংলাদেশে ২৮৮টি বন্যপ্রাণী হত্যা করে মানুষ। এভাবে প্রাণ-প্রজাতির প্রশ্নহীন বিলুপ্তি ঘটছে কেন? আমরা রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে বহু অঙ্গীকার করেছিলাম।

সেসব অঙ্গীকারের কী হলো? প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় আমরা আমাদের অঙ্গীকারগুলোকে বারবার কেন দাবিয়ে রাখছি? রাষ্ট্র হিসেবে প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় বাংলাদেশ সাংবিধানিকভাবে সেই অঙ্গীকার করেছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার খুব কম দেশের সংবিধানেই দৃশ্যমান। সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় উল্লেখ আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ প্রাণ-প্রজাতি সুরক্ষায় নাগরিক-রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক অঙ্গীকারগুলো জোরালো ও সক্রিয় করার আহ্বান জানাই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত