স্বাধীনতার মহা নায়কের মহা প্রত্যাবর্তন

জিয়াউল হক

প্রকাশ : ১০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হওয়া যুগপৎ আন্দোলনের সফল সমাপ্তি ঘটে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে স্বাধীন স্বদেশে স্বাধীনতার মহা নায়কের মহা আগমণের মাধ্যমে।

আর স্বাধীনতার সেই মহা নায়কটিই হচ্ছেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সুদীর্ঘ দুই যুগের ধারাবাহিক আন্দোলনের পর মহা নায়কের জীবন্ত অবস্থায় স্বদেশে আগমন বাঙালি জাতির জন্য ছিল এক পরম পাওয়া।

জীবন্ত অবস্থায় বলার হেতু হলো তাকে যে কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল তার পাশে তাকে দাফনের জন্য কবর খুঁড়ে রাখা হয়েছিল। হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের অধিকারী মহা মানবটি রাজনৈতিক জীবনে কখনো কোনো অন্যায় ও অন্যায্যের কাছে মাথা নত করেননি। বারংবার বীরের বেশে কারাগারে প্রবেশ করেছেন বারংবার মাথা উঁচু করেই কারাগার থেকে জনতার মাঝে ফিরে এসেছেন।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ লন্ডন থেকে ভারত হয়ে দুপুর প্রায় পৌনে দুটি নাগাদ বঙ্গবন্ধু বহনকারী কমেট জেট বিমান কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে অবতরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ের ষোলকলা পূর্ণ হয়। বঙ্গবন্ধু যখন বিমান থেকে স্বদেশের মাটিতে পা রেখে এই মাটি তার ললাটে স্পর্শ করেন এর মাধ্যমেই বাংলার মাটি ও মানুষের প্রতি তার প্রগাড় মমত্ববোধের চিত্রফুটে উঠে। রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে তিনি শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি ও স্বাধীনতায় সহায়তাকারী বিশেষ করে ভারত ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তার আগমনের মধ্যদিয়েই সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের নবযাত্রা শুরু হয়।

রক্তক্ষয়ী ৯ মাসের যুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তানের চৌকস সামরিক বাহিনী ও এ- দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আলবদর, আল-শামসেরের প্রত্যক্ষ সহায়তায় যুদ্ধপরিস্থতি কঠিন করে তুলেছিল। কঠিনতর ওই মুহূর্তে বাঙালি জাতির জন্য জিয়নকাঠি হয়ে ধরা দিয়েছিল ৩ ডিসেম্বরর মিত্রবাহিনী গঠিত হওয়ার সংবাদ। ৪ ডিসেম্বর যৌথবাহিনী সম্মুখসমরে নামে। এরপর আর বেশি দিন যুদ্ধ করতে হয়নি। মাত্র ১২ দিনের মাথায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মূলত যৌথবাহিনী গঠিত হলে পাকিস্তানি বাহিনীর মনোবল ভেঙে যায়। তারা উপলব্দি করে পরাজয় সন্নিকটে। শুধু আনুষ্ঠানিকতা বাকি।

আর নিশ্চিত পরাজয় জেনেই উন্মাদ পাকিস্তানি বাহিনী এদেশের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যাযজ্ঞে নেমে পড়ে। আর এই যজ্ঞেও সহায়তা করে পাকিস্তানি বাহিনীর দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল-শামস। ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জন হলেও বাঙালি জাতি অতটা খুশি হতে পারেনি। এই অখুশির কারণ বিজয়ের মহা নায়ক তখনও অধরা।

বাঙালি মনে অজানা শঙ্কা। উৎকণ্ঠিত বাঙালির চোখে মুখে জিজ্ঞেস ছিল। বঙ্গবন্ধু কি বেঁচে আছে? বেঁচে থাকলে কোথায় আছে? কেমন আছে? কবে ফিরবে? আদৌও ফিরবে তো? নাকি ফিরবেই না? কসাই পাকিস্তান তাকে হত্যা করেনি তো? অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এ রকম হাজারো উৎকণ্ঠা বাঙালির মনে ঘুর পাকিস্তানি খেত। বঙ্গবন্ধু বেঁচে আছে এ-সম্পর্কীয় খবর ১৯৭২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে বিশ্ব গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হয়।

আর তখনই বিশ্ব সম্প্রদায়ের টনকনড়ে। বঙ্গবন্ধু মুক্তির জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ভারতের স্বর্গীয় প্রধানমন্ত্রী মহামতি ইন্দিরাগান্ধী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য পাঁচটি দেশ সফর করেন এবং ৬৭ দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানকে চিঠি দিয়ে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির স্বপক্ষে সমর্থন কামনা করেন। অবশ্য বঙ্গবন্ধু মুক্তির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। তা হলো পাকিস্তানের ৯০ হাজার সৈনিক যুদ্ধবন্দি হিসেবে বাংলাদেশে মিত্র বাহিনীর জিম্মায় ছিল। বঙ্গবন্ধুকে মন্দ কিছু করার চিন্তা করলে এই সৈন্যদের জীবন বিপন্ন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অস্তিত্ব সংকটের ঝুঁকি ছিল। বিশ্ব জনমতও তখন পাকিস্তানের বিপক্ষে। চতুর্মুখী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নতিস্বীকার করে অবশেষে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি ভোরে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। অবসান হয় বঙ্গবন্ধুর এ যাত্রার ২৯০ দিনের কারাবাস। অবশ্য এটাই ছিল তার সর্বশেষ কারাবাস। সদ্য দ্বি-খণ্ডিত পাকিস্তানকে পুনরায় জোড়া কিংবা ন্যূনতম কোনো সম্পর্ক রাখা যায় কি না, এই প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভুট্টো বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্ক টিকে রাখার বিষয়ে অনুরোধ করলে বঙ্গবন্ধু সুকৌশলে বলেন- ‘দেশে ফিরে সকলের সঙ্গে আলোচনা না করে তিনি কোনো সিদ্ধান্ত জানাবেন না। সাক্ষাৎ শেষে ভুট্টো সাহেব বঙ্গবন্ধুকে শর্তহীন মুক্তি দিয়ে দেশে পাঠানোর বিষয়েও আশ্বস্ত করেন।

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে সরাসরি নিজ দেশে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জেনেভা কনভেনশনের শর্তানুযায়ী তা সম্ভব ছিল না। পরে পাকিস্তান তাদের মিত্ররাষ্ট্র তুরস্ক অথবা ইরান এই দুটির একটি বেছে নিতে বললে বঙ্গবন্ধু তা নাকচ করে দেন। শেষ উত্তম বিকল্প হিসেবে লন্ডনে যাওয়ার প্রস্তাব দিলে তিনি সম্মতি দেন। এই সম্মতিরও অবশ্য কারণ ছিল। তা হলো বাংলাদেশ ভারতের পর সবচেয়ে বেশি বাঙালির বসবাস ছিল লন্ডনে। ৮ জানুয়ারি ভোর ৬টায় বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমান লন্ডনের হিথ্রোরো বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বঙ্গবন্ধু লন্ডনের রাষ্ট্রীয় অতিথিদের জন্য সংরক্ষিত হোটেল ক্লারিক্লারিজে উঠেন।

ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে এতটাই মর্যাদা ও ইজ্জত দিয়েছেন যে বঙ্গবন্ধু যখন লন্ডনে পৌঁছেন তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ব্যক্তিগত কাজে লন্ডনের বাহিরে অবস্থান করছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতির সংবাদ পেয়ে পূর্ব-নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে ১০নং ডাউনিং স্টিটে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর সমাদর করেন।

তিনি বঙ্গবন্ধুর গাড়ির দরজা পর্যন্ত খুলে দিয়ে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। স্বদেশে ফেরার পথে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে তাদের রাজকীয় বিমান কমেট জেটে তুলে দেন। ফেরার পথে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লিতে ২ ঘণ্টা যাত্রা বিরতি দেন। এ সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদর্শন করেন। ভাষণে বঙ্গবন্ধু মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অসামান্য অবদানের কথা উল্লেখ্য করে অবিলম্বে বাংলাদেশ থেকে ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। দিল্লির বিরতি শেষে নিজ দেশের উদ্দেশ্য পুনরায় যাত্রা শুরু করেন। অবশেষে বাঙালির জীবনে দেখা দিল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যে ক্ষণের জন্য ৭ কোটি বাঙালির এত প্রতীক্ষা। বিমানের কপাট খুলে বেড়িয়ে এলেন স্বাধীনতার মহা নায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।