ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বঙ্গবন্ধুর আগমনে বিজয়ের পূর্ণতা

সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে যাবেন শেখ হাসিনা
বঙ্গবন্ধুর আগমনে বিজয়ের পূর্ণতা

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি অকার্যকর রাষ্ট্র পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হবার দুই দিন পর ১০ জানুয়ারি মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার ফিরে আসার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ী বাঙালি জাতির বিজয় পূর্ণতা পায়। বঙ্গবন্ধুকে সাড়ে নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারের অন্ধকার ঘরে বন্দি রাখা হয়েছিল। ২৪ ডিসেম্বর একটি হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির অদূরে শিহালা পুলিশ একাডেমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তানি শাসক। দৈহিকভাবে নির্যাতন করা না হলেও নানাভাবে মানসিকভাবে হয়রানি করা হয়েছে এই অবিসংবাদিত নেতাকে। পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘকাল নিঃসঙ্গ এবং বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কোনো যোগাযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে তার আত্মিক যোগাযোগ ছিল- ‘জনগণের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক কখনো ছিন্ন হয়নি, এক মুহূর্তের জন্যও নয়। ... যখন বিপদ আমাকে আচ্ছন্ন করত, আমি বুঝতে পারতাম আমার জনগণ তীব্র যন্ত্রণা ভোগ করছে। এছাড়াও আরও নানা রকমের অত্যাচার ছিলো সেখানে। যন্ত্রণাদায়ক বন্দিজীবন থেকে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছান। লল্ডন থেকে ৯ জানুয়ারি রাতে রওনা হয়ে ১০ জানুয়ারি দুপুরে দিল্লিতে উপস্থিত হন বিকাল ৪টায় দেশে ফেরার ঠিক আগে। দিল্লি বিমানবন্দরে স্বাধীন বাংলাদেশের এই মহানায়ককে স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বিমানবন্দরে এ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অভ্যর্থনা সভায় সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু ও ইন্দিরা গান্ধী।। বঙ্গবন্ধু সেদিন তার বক্তৃতায় ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনগণের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলেন- ‘তার শরীরকে জেলখানায় বন্দি করে রাখা হলেও তার আত্মাকে কেউ বন্দি করে রাখতে পারেনি। তার প্রেরণায় বাংলাদেশের মানুষ সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছে। ঢাকার মাটি স্পর্শ করার পর উপস্থিত জনতার ঢল দেখে নিজের অশ্রু সংবরণ করতে পারেননি বঙ্গবন্ধু। বিশাল জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে জাতিকে দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দেন, ক্লান্ত কণ্ঠে তিনি জানান- ‘আমি আজ বক্তৃতা করতে পারবো না।’ তারপরও তিনি বলেন, ‘আজ আমি যখন এখানে নামছি আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারবো কি না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।’ তিনি এই ঐতিহাসিক ভাষণে যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। স্বাধীন দেশে দাঁড়িয়ে মুক্ত মানুষের দিকে চেয়ে বলেন- ‘আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই আমার সোনার বাংলা তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। আমি আশা করি দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই, আমার জনগণ গৃহহারা সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারী। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও দিতে হবে। আমি আমরা হার মানবো না আমরা হার মানতে জানি না। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে চূর্ণ হয়ে যায় এই উপমহাদেশের যুগ-যুগান্তরের চিন্তার অস্থিরতা ও মানসিক অচলায়তন। তার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশের মানুষ যেমন ফিরে পায় সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রেরণা, তেমনি তিনি হয়ে ওঠেন বাঙালির আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। একই সঙ্গে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অন্ধকার শক্তির সর্বনাশের সূচনাও হয় তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভেতর দিয়ে। বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ জনতা। এক একজনের চোখে-মুখে অন্যরকম উত্তেজনা। নেতা আসছেন। আসছেন প্রিয় পিতা। পাকিস্তানের কারাগারের শৃঙ্খল ছিঁড়ে দেশের মাটিতে আসছেন সেই মহামানব, যিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। এক সময় অপেক্ষার পালা শেষ হয়। পিতা দৃশ্যমান হন। সেই দীর্ঘ ঋজু দেহ, প্রিন্স কোট আর উজ্জ্বল মুখচ্ছবি। চেহারায় কি একটু ক্লান্তির ছাপ। পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘদিন থাকা। তারপর পথের ক্লান্তি তো আছেই। একত্রিশবার তোপধ্বনি আর লাখো মানুষের উল্লাস। বঙ্গবন্ধুকে বরণ করল তার প্রিয় স্বদেশ, প্রিয় মাটি। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। প্রিয় দেশের বাতাস নিলেন বুক ভরে। স্পর্শ করলেন এই দেশের মাটি। প্রিয় আলো তাকে ছুঁয়ে দিল। তিনি বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় পৌঁছান। অত্যন্ত ক্লান্ত শেখ মুজিব তার ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো জাতিকেই স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। তিনি বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতরকার সমস্ত সম্পর্ক চিরতরে শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, সমস্ত দেশই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং বাংলাদেশ অবশ্যই জাতিসংঘের সদস্যপদ পাবে। শেখ মুজিব বলেন, বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। তিনি তার ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করার অপরাধে হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করেন। তিনি আশা করেন, অবশ্যই এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত হবে। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তার দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছিল বারবার। তিনি আবেগভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং চিরদিন স্বাধীন থাকবে।’ এই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সব সময় জনগণ তার প্রথম চাওয়া ও পাওয়া। ৯ মাস ১৬ দিন কারাবাস শেষে যেদিন দেশে ফিরলেন তিনি সেদিন প্রথম গেলেন জনগণের কাছে। স্ত্রীর মুখ কি তার মনে পড়েনি? মনে পড়েনি সন্তানদের কথা? বাড়িতে বৃদ্ধ পিতা, বৃদ্ধা মা। কাউকে কি মনে পড়েনি তার। জনগণের নেতা জনগণের কাছেই আগে ফিরেছেন। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে এলেও এ দেশের কিছু মানুষের চক্রান্তে শেষ পর্যন্ত দেশের মাটিতেই জীবন দিতে হয়েছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই মহান নেতাকে। বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মাঝে নেই; কিন্তু তার নীতি ও আদর্শ রয়ে গেছে। বাঙালি জাতি বহন করছে তার উত্তরাধিকার। যতদিন বাংলাদেশ আছে, আছে বাঙালি জাতি, বঙ্গবন্ধুর উত্তারাধিকারও ততদিন থাকবে। বাঙালির ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারির আবেগ ও আনন্দ আজকের দিনে বুঝিয়ে বলা কঠিন। স্বপ্ন ছিল তার একটি স্বাধীন দেশের। স্বপ্ন ছিল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের। স্বপ্ন ছিল এদেশের খেটে খাওয়া মেহনতী মানুষের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার। বঙ্গবন্ধু একটি অসাম্প্রদায়িক, সাম্যের বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। ধর্মীয় মৌলবাদমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। তাই বিচার শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বুকে নিয়ে দিনযাপন করেছে। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা, যিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, তিনি জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বাবার মতোই তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমৃদ্ধির দিকে। আজ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে আমরা সবাই নতুন করে তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার শপথ নেব। সাম্যের ভিত্তিতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাতকে শক্তিশালী করব। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে অনুস্মরণ করে তার কন্যা শেখ হাসিনা দেশের মানুষের কল্যাণে নিরলস পরিশ্রম করছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি আধুনিক স্মার্ট ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় নিয়ে নতুন মেয়াদে দেশকে আরো সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবেন সেই কামনা দেশবাসীর।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত