গণমাধ্যম, সাংবাদিকতা ও সামাজিক দায়িত্ব

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে গণমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব দেশে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যপক জোরালো ভূমিকা পালন করতে হয়। বিশ্বে প্রতি বছরই অনেক সাংবাদিককে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। যদিও গত বছর এই সংখ্যা একটু কমেছে। আরএসএফের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের প্রথম ১১ মাসে ৪৫ সাংবাদিক দায়িত্ব পালনকালে নিহত হয়। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ৬১। ল্যাতিন আমেরিকায় সাংবাদিকের প্রাণহানি ব্যাপকভাবে কম হওয়ায় এ সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এদিকে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধ শুরুর পর প্রায় ৬৩ সাংবাদিক নিহত হয়েছে। তবে এদের মধ্যে ১৭ সাংবাদিকের নিহত হওয়া আরএসএফের সংজ্ঞার আওতায় পড়ে। আরএসএফের সেক্রেটারি জেনারেল ক্রিস্টোফ ডেলোরি বার্তা সংস্থা এএফপি’কে বলেছেন, প্রতিনিয়তই সাংবাদিক নিহতের সংখ্যা কমার বিষয়টি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ২০১২ সালে ১৪০ সাংবাদিক নিহত হয়েছিল। একইরকম ২০১৩ সালেও প্রত্যক্ষ করেছি। সিরিয়ার ও ইরাক যুদ্ধের কারণে এমনটি ঘটেছিল। ইসরায়েল ও হামাস যুদ্ধে ১৭ সাংবাদিক নিহত হয়। এর মধ্যে ১৩ জন গাজায় ইসরায়েলি হামলার সময়ে একজন লেবাবন এবং অপরজন ইসরায়েলে হামাসের হামলার সময়ে নিহত হয়। আইপিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালের চেয়ে ২০২২ সালে বিশ্বে বেশিসংখ্যক সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মী পেশাগত কারণে নিহত হয়েছেন। ২০২১ সালে বিশ্বে ৪৫ সাংবাদিক নিহত হয়েছিলেন।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ বলা হয়। সে হিসেবে এই স্তম্ভটি হওয়া উচিত অত্যন্ত শক্তিশালী। কোনো দেশের উন্নয়নে মুক্ত গণমাধ্যম অন্যতম শর্ত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া উচিত। কারণ গণমাধ্যম রাষ্ট্রের পরিচালিত ব্যবস্থার খুঁটিনাটি দিকগুলো চিহ্নিত করে এবং তা বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ বাতলে দেয়। গণমাধ্যমের প্রকার এখন বিস্তৃত। টেলিভিশন চ্যানেল, প্রিন্ট পত্রিকা এবং রেডিওর সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন পত্রিকা, অনলাইন টিভি এবং অনলাইন রেডিও রয়েছে প্রচুর। প্রতিদিন নতুন নতুন পত্রিকা বের হচ্ছে। যদিও মানুষ এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকেই বেশিরভাগ সংবাদ জানতে পারে। তা জানুক। জানার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এই সহজাত প্রবৃত্তি পূরণের জন্যই গণমাধ্যমগুলো কাজ করে। এর সঙ্গে যুক্ত কর্মীরা প্রতিনিয়ত মানুষের তথ্য জানার আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে তা সংগ্রহ এবং প্রচার করছে। এই তথ্য জানানোর কাজটি সবক্ষেত্রে সহজ হয় না। অনেক সময় ক্ষমতাশালীর রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করেই তাকে তার কাজ করতে হয়। হরহামেশাই সাংবাদিককে তথ্য সংগ্রহের সময় হয়রানির শিকার হতে হয়। কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখিও হতে হয়। এত কিছুর পরেও সে সেসব বাধা উপেক্ষ করেই তার কাজ চালিয়ে যায়। প্রতিটি মুহূর্তে একজন গণমাধ্যমকর্মীর ঝুঁকির মধ্যে কাজ করে যেতে হয়।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূল কথা হলো রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক জণগণ। তাই তথ্য জানার অধিকার জণগণের রয়েছে। আর তথ্য জানানোর দায়িত্বও রয়েছে। সেজন্য গণমাধ্যমকে সমাজের আয়না হিসেবে পরিগণিত করা হয়। আয়নায় যেরুপ নিজের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে, গণমাধ্যমেও সমাজের প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেই ছবি ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব নেন গণমাধ্যমকর্মী। দেশে এখন শত শত পত্রিকা। জাতীয়, স্থানীয়, সাপ্তাহিক মাসিক পাক্ষিকসহ বিভিন্ন পত্রিকা টেলিভিশন এবং অনলাইনে কাজ করা সারাদেশে ছড়িয়ে রয়েছে লাখ লাখ সাংবাদিক। তবে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এখানেও রয়েছে বিভক্তি। জেলায়-উপজেলায় সাংবাদিকদের নানা সংগঠন গড়ে উঠেছে। পত্রিকায় কাজ করা প্রান্তিক পর্যায়ের সাংবাদিকদের পরিশ্রম করতে হয় ঠিকই; কিন্তু তাদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিছুই দেয়া হয় না। পত্রিকা প্রকাশের বিজ্ঞাপন দিলেই প্রচুর সংখ্যক আবেদন পাওয়া যায় সাংবাদিকতা করার জন্য। তারা এটা জানে যে এখান থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা পাওয়া যাবে না। এটা জেনেও এই পেশায় যুক্ত হতে যারা আসছে তারা প্রশংসার দাবিদার। সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের সঙ্গে যুক্ত থাকা সম্মানের জন্যই মূলত এত আগ্রহ দেখা যায়। সংবাদ সংগ্রহের বিপরীতে তাদের আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব দেশ এবং বিদেশের সংবাদ প্রকাশ এবং বিশ্লেষণ করে জনগণকে সচেতন করে। এছাড়া বিনোদন এবং শিক্ষামূলক কাজেও গণমাধ্যম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে প্রতিনিয়তই। গণমাধ্যমে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। গণমাধ্যম তখনই সার্থকতা পায়, যখন জনগণের উপকারে এসে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে। এজন্য গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং মুক্ত প্রকাশ সর্বাগ্রে প্রয়োজন। সারা বিশ্বেই গণমাধ্যমকর্মীদের নানাভাবে নির্যাতিত হতে হয়। জেল জরিমানা হুমকি-ধমকি এসব সহ্য করতে হয়। তারপরেও গণমাধ্যমকর্মীদের সংবাদ সংগ্রহ থেমে থাকে না।

রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের সৈনিকদের থেমে থাকলে চলে না। ঝুঁকি নিয়েই কাজ করতে হয়। গণমাধ্যম বরাবরই দুর্বলের পক্ষে থেকে লড়াই করে। তাই এ পথটা বেশ কঠিন হয়। গণমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা। রাষ্ট্রের একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত উন্নয়নে কোন দুর্নীতি বা অনিয়ম হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখা। জনগণের প্রাপ্য জনগণ ঠিকমতো পাচ্ছে কি না, তাও দেখার দায়িত্ব রয়েছে। গণমাধ্যমের ইতিবাচক ভূমিকা সমাজের সবক্ষেত্রে আবশ্যক। সরকারের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত জনগণকে অবহিত করার কাজটিও গণমাধ্যম করে থাকে। গণমাধ্যম হলো উন্নয়নের অংশীদার। দেশকে উন্নত করতে হলে মুক্ত গণমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। যে দেশ গণমাধ্যমকে মুক্তভাবে মতামত প্রকাশের সুযোগ দিয়েছে সেসব দেশ এগিয়েছে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই আজকাল মুক্ত গণমাধ্যম চর্চার সুযোগ নিয়েই মূল ধারার বাইরের কিছু গণমাধ্যম নামের লেবাসধারী সমাজে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছাড়ানো এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য ছড়ায়। এটা সমাজের জন্য হিতকর নয় এবং গণমাধ্যমের কাজও এটা নয়। এটা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক এবং এসব গণমাধ্যম তার উদ্দেশ্য সাধন করেই শেষ হয়। সাংবাদিকরা জনগণের ভেতরের শব্দ ফুটিয়ে তোলেন। সেক্ষেত্রে বলা যায়, সাংবাদিকতা একটি ক্ষমতা। তবে এই ক্ষমতা মানুষের জন্য, কোনো ব্যক্তি বিশেষকে সন্তুষ্টি করার জন্য নয়।

ক্ষমতার শব্দটি দায়িত্বশীলতার প্রতি দায়বদ্ধ থাকাই উত্তম। এর অর্থ আপনার ক্ষমতাকে দায়িত্বে রুপান্তর করা উচিত। কেননা, কলম তরবারির চেয়েও শক্তিশালী। গণমাধ্যমকর্মীর যুদ্ধ কলম দিয়ে। এই যে আজ বাংলাদেশে শত শত গণমাধম রয়েছে এবং প্রতিদিন আরো গণমাধ্যম যোগ হচ্ছে তার ওপর সাধারণ মানুষ কতটুকু আস্থা রাখতে পারছে বা পাঠক কতটুকু সময় সেই গণমাধ্যম দেখছে। গাড়িতে প্রেস লিখে অনেকে অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। পকেটে পাওয়া যাচ্ছে, একেবারে অচেনা কোনো ডটকম জাতীয় পত্রিকার পরিচয়পত্র। অনেক পত্রিকার পরিচয় ফেসবুকে খবর শেয়ারের মাধ্যমে সিমাবদ্ধ। যারা গণমাধ্যমের নাম দিয়ে শুধু অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করতেই এসেছিল বা নিজের পিঠ বাঁচাতে এসেছিল। এসব গণমাধ্যমের থেকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ এরা হুট করে এসে আবার হারিয়ে যায়। গণমাধ্যমে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে দেশের শিক্ষিত শ্রেণির ভেতরেও। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেকেই গণমাধ্যমে কাজে আগ্রহী হচ্ছে। বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের আকর্ষণ করছে। এছাড়া নারীদের একটি বড় অংশ এখন গণমাধ্যমে কাজ করছে। দিন দিন এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কাজের ক্ষেত্রে একটি সমতা গণমাধ্যম করে যাচ্ছে। জনগণের আস্থা অর্জন মুখ্য বিষয়। কতটি গণমাধ্যম আজ মফঃস্বল এলাকায় নিয়োজিত কর্মীদের জন্য বেতন ভাতা নিশ্চিত করে নিজেদের জন্য একটি দক্ষ জনবল তৈরি করতে পেরেছে। বিষয়টি প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ আজকাল নিয়োগ দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে অনেকে। সেই কর্মীর প্রতি এর বাইরে আর কিছু করার প্রয়োজন পরে না। বেতন-ভাতা তো পরের কথা ন্যূনতম পকেট খরচও অনেক গণমাধ্যমকর্মীর কপালে জোটে না। এই ব্যর্থতার কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এই ব্যর্থতা ঢাকতে অন্য কাউকে নয়- গণমাধ্যমকেই এগিয়ে আসতে হবে।

প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট