কৃষি খাতে ব্যাপক সাফল্য

মো. বশিরুল ইসলাম

প্রকাশ : ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ টন। তখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য খাদ্য জোগানে ঘাটতি ছিল। বর্তমানে ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৬৬ লাখ ৮৭ হাজার টন। দেখা যাচ্ছে, স্বাধীনতার পর দেশের মানুষ বেড়ে আড়াই গুণ হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে চার গুণেরও বেশি। ১৯৭১-৭২ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ; এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশ। তারপরও জনপ্রতি সরবরাহ কমছে না কৃষিপণ্যের; বরং তা দিন দিন বাড়ছে। আর এভাবেই প্রধান খাদ্যশস্যের উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এখন প্রশ্ন আসতে পারে? দেশে একদিকে আবাদি জমি কমছে, বিপরীতে বাড়ছে জনসংখ্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি। তারপরও কীভাবে দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ছে? এর পেছনে নায়ক কারা? এ উত্তর হচ্ছে সরকারের পরিকল্পনা, পরিশ্রমী কৃষক এবং মেধাবী কৃষি বিজ্ঞানী ও সম্প্রসারণবিদদের যৌথ প্রয়াসেই খাদ্যঘাটতি থেকে দেশ আজ খাদ্যে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পেরেছে। চিরাচরিত চাষাবাদের ধরন বদলে যাচ্ছে কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে। দেশে এখন বছরে গড়ে দুটি করে ফসল হচ্ছে। কোথাও কোথাও তিন ফসলও হচ্ছে। আসলে, কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি, বীজ, সার এবং যন্ত্রের ব্যবহার উৎপাদন বাড়ার পেছনে প্রধান উজ্জীবক শক্তি হিসেবে কাজ করছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্চফলনশীল জাতের বীজ এবং পরিবেশসহিষ্ণু বিভিন্ন ফসল। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বের সেরা ১০-এ জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইলিশ এবং মৌসুমি ফলের মধ্যে কাঁঠাল উৎপাদনে প্রথম, পাট, সুপারি ও শুকনা মরিচ উৎপাদনের দ্বিতীয়, চাল এবং রসুন উৎপাদনে তৃতীয়, মাছ এবং জামের মতো ফল ও সুগন্ধি মসলা উৎপাদনে চতুর্থ, মসুর ডাল ও গ্রীষ্মমন্ডলীয় ফল উৎপাদনের ষষ্ঠ, পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি ও নারিকেলের ছোবড়া উৎপাদনে সপ্তম, চা ও কুমড়া উৎপাদনের অষ্টম, আম ও পেয়ারা, ফুলকপি ও ব্রকলি, মটরশুঁটি এবং পাখির খাদ্য উৎপাদনে নবম। ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ আর ছাগলের মাংস উৎপাদনে পঞ্চম। বাংলাদেশের ব্লাক বেঙ্গল জাতের ছাগল বিশ্বের সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের ৯৪তম দেশ হলেও এফএও’র হিসাবে দেখা যায়, প্রাথমিক কৃষিপণ্য শুধু ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪তম। শুধু কী ফসল উৎপাদনে, ফসলের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও আমাদের বিজ্ঞানীদের সফলতা বাড়ছে। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কয়েকটি জাত ছাড়াও এরই মধ্যে পাটের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে। ইলিশ মাছের জীবনরহস্য উন্মোচন করেছে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের দুটি দল। মহিষের জিন নকশা উন্মোচনের মাধ্যমে আবিষ্কারে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশের বারোমাসি একটি কাঁঠালের জীবন রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচিত হওয়ায়, জৈবপ্রযুক্তির মাধ্যমে নানা স্বাদের এবং বৈশিষ্ট্যের কাঁঠালের নতুন জাত উদ্ভাবন সম্ভব হবে, যা দেশে কাঁঠালের বাণিজ্যিক চাষাবাদ এবং প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশে সহায়ক হবে। হালদা নদীর চারটি কার্প জাতীয় মাছ রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ এবং ডলফিনের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন বা জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছেন গবেষকরা। লবণ ও বন্যাসহিষ্ণু ধানের পূর্ণাঙ্গ জীবনরহস্য উন্মোচন করেছেন গবেষকরা। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক লবণাক্ততা ও বন্যাসহিষ্ণু বিনাধান-২৩ এর ওপর গবেষণা করে এই সাফল্য পেয়েছেন। ফলে বাংলাদেশে ধান গবেষণায় নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত ১১৩টি ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা ২৪টি লবণসহিষ্ণু, খরাসহিষ্ণু, বন্যাসহিষ্ণু এবং প্রতিকূল পরিবেশে সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন করেছেন। এমনকি জিঙ্কসমৃদ্ধ ধানের জাতও উদ্ভাবন করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এতগুলো প্রতিকূল পরিবেশসহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকেও বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষে। দেশের জলবায়ু ও কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট এ পর্যন্ত বিভিন্ন ফসলের ৬৫২টি উচ্চ ফলনশীল জাত এবং ৬৪০টি ফসল উৎপাদনের প্রযুক্তিসহ মোট ১২৯২টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ডাল, তেলবীজ, সবজি, ফল ইত্যাদির ১০০০০ এর অধিক কৌলি সম্পদ (জার্মপ্লাজম) জিন ব্যাংকের মাধ্যমে সংরক্ষণ করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০২২’ বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান ধরে রেখেছে। আর চাষের মাছে বাংলাদেশ দুই ধাপ এগিয়ে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ টন, যা ২০০৭-০৮ অর্থবছরের মোট উৎপাদন ২৫ দশমিক ৬৩ লাখ টনের চেয়ে ৮৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ বেশি। মাথাপিছু দৈনিক মাছ গ্রহণের চাহিদা ৬০ গ্রাম থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৭.৮০ গ্রাম। বর্তমানে বাংলাদেশের মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য ৫২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, ফ্রান্স, আমেরিকা, জাপান, রাশিয়া অন্যতম। বৈশ্বিক আর্থিক মন্দায়ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬৯ দশমিক ৮৮ হাজার টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। গরু ও ছাগল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়। দুধ উৎপাদনের বৈশ্বিক সূচকেও কয়েক বছর ধরে এ দেশের ধারাবাহিক অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বেশ কয়েক বছর ধরে ছাগলের দুধ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে। তবে মোট দুধ উৎপাদনে দেশের অবস্থান বিশ্বে ২৩তম। গরুর দুধ উৎপাদন গত ১০ বছরে বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন গরুর সংখ্যা ২ কোটি ৪৮ লাখ ৫৬ হাজার। ২০১৩-১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার। দশ বছর ব্যবধানে গরু বেড়েছে ১৪ লাখের কাছাকাছি। অন্যদিকে দেশে বর্তমানে ছাগলের সংখ্যা ২ কোটি ৬৯ লাখ ৪৫ হাজার। দশ বছর আগে ছাগলের সংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৪ লাখ ৩৯ হাজার। গরু-ছাগল ছাড়াও ওই প্রতিবেদনে ভেড়া ও মহিষের হিসাবও দেওয়া হয়েছে। দেশে এখন ১৫ লাখ ১৬ হাজার মহিষ আছে। ২০১৩-১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪ লাখ ৫৭ হাজার। অন্যদিকে দেশে বর্তমানে ভেড়ার সংখ্যা ৩৮ লাখ ২৭ হাজার। ২০১৩-১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩২ লাখ ৬ হাজার। দশ বছর ব্যবধানে ভেড়ার বেড়েছে ৬ লাখের বেশি।