শিশু শিক্ষায় অমানবিকতা

আরিফ আনজুম

প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শিশু শিক্ষায় অমানবিকতা। শৈশব থেকে আমরা নানা নীতিবাক্য পড়ে আসছি- ‘সদা সত্য কথা বলিও’, ‘অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করো’, ‘যেখানে- সেখানে আবর্জনা ফেলিও না’। বাস্তবে এ বাক্যগুলোর কতটুকু আমরা ধারণ করতে পেরেছি, তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। শুধু মুখে নৈতিক শিক্ষার বাক্য না শিখিয়ে ব্যবহারিক কাজের মাধ্যমে শিক্ষাকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। সামান্য একটি উদাহরণ যেমন- বিদ্যালয় ও বাড়িতে কাগজপত্র, ময়লা-আবর্জনা নির্দিষ্ট ঝুড়িতে নিয়মিত ফেলার অভ্যাস গঠনের মাধ্যমে পরিবেশ সুরক্ষার পাঠ শুরু হতে পারে। ভালো কাজ, সততার স্বীকৃতি, পুরস্কার প্রদান, সহপাঠীদের সঙ্গে মেলামেশা, ওপরের শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্মান, স্নেহ ইত্যাদির প্রতি শিক্ষকের সুদৃষ্টি থাকতে হবে। কোনো শিক্ষার্থী টিফিন না আনলে বা শিক্ষা উপকরণের অভাব হলে সবাই মিলেমিশে তার অভাব দূর করা, অন্যান্য নৈতিক কাজ যেমন- সালাম, শিষ্টাচার, আচার-আচরণের পরিবর্তন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ও খেলাধূলাসহ পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি পত্রিকা ও নানা জ্ঞানসমৃদ্ধ বই পাঠের অভ্যাস করতে হবে।

শিশুর বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন হয় পরিবেশকে জানার। মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কে জানা, তার এলাকার নাম, পরিবেশের সবকিছুর নাম বলতে পারা। ধীরে ধীরে শিশুর হাতে তুলে দিতে হবে বিভিন্ন রঙের ছবি সংবলিত বই। পাশাপাশি ছড়া আবৃত্তি, রং দিয়ে মনের মতো আঁকাআঁকি করতে দেয়া, আঁকাজোকার মধ্য দিয়ে লেখার অভ্যাস গঠন শুরু করতে হবে। কিন্তু এর পরিবর্তে আমরা কী করছি? আমরা আদরের সোনামণিদের ওপর শিক্ষার নামে নির্মম যন্ত্রণা চাপিয়ে দিচ্ছি। শিশু শিক্ষার প্রারম্ভে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত সবাই একযোগে শিশুকে বাংলা, ইংরেজি বর্ণমালা শেখানোর চেষ্টায় লিপ্ত থাকেন। এক্ষেত্রে শিশুর মানসিক সামর্থ্যকে বিবেচনায় না আনায় তার আগ্রহকে গুরুত্বহীন করে তোলা হচ্ছে। এর ফলে শিশুর পাঠগ্রহণ আজ তার কাছে নিরানন্দ হয়ে উঠেছে। নামিদামি বিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির প্রয়াসে শিশুকে তার শৈশবের স্বর্গীয় আনন্দ বিসর্জন দিয়ে শিখতে হয় বড়দের জ্ঞান, বয়স, রুচি ও সামর্থ্যরে শিক্ষা, যা তার জন্য অতিরিক্ত বোঝাস্বরূপ। শিশুরা তোতা পাখির মতো অনেক বড় বড় কঠিন শব্দ মুখস্থ বলতে পারে। অথচ শিশু বিষয়বস্তু সম্পর্কে কোনো জ্ঞান বা ধারণা রাখে না। শিশুদের জ্ঞানহীন ‘জ্ঞানার্জন’ অভিভাবকদের পুলকিত করে থাকে। চলতে থাকে সারা দিন শুধু লেখাপড়া। শিশুর জীবন থেকে বিদায় নেয় সকাল-বিকালের সূর্য দেখা, খেলাধুলা, সহপাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমসহ সব বিনোদন। সকালে বাসায় পড়া, স্কুলে পড়া, কোচিং ক্লাসের পড়া, রাত জেগে শুধু পড়া আর লেখা নিত্যদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের সন্তানরা আরামণ্ডআয়েশ, বিনোদন, খেলাধুলাকে বিসর্জন দিয়ে শুধু পড়ছে তো পড়ছেই। এ পড়ালেখা শিশুকে কতটা বিকশিত করছে, সমাজকে কতটুকু উপকৃত করছে, দেশকে কী দিচ্ছে- বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।

শিশু মনোবিজ্ঞানবহির্ভূত শিক্ষা শিশুদের জোর করে শেখানোর পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, এ বয়সে যদি লেখাপড়ার ওপর চাপ না দেয়া হয়, তবে বড় হয়ে পড়ার অভ্যাস গড়তে সমস্যা হবে।

প্রত্যেক কাজের জন্যই সময় নির্ধারিত রয়েছে। মাতৃদুগ্ধ পানের মেয়াদ যেমন নির্দিষ্ট, প্রথম শ্রেণির ভর্তির বয়স, এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার বয়স, চাকরির বয়স। কিন্তু শিশুশিক্ষার জন্য বয়সের বিষয়টিকে গুরুত্বহীনভাবে দেখা হচ্ছে। প্রথম শ্রেণি থেকে পরীক্ষা দিতে দিতে শিশুর পরীক্ষা দেয়ার অভ্যাস গড়ে উঠবে কিংবা পরীক্ষাভীতি কমে যাবে, এটা খোঁড়া যুক্তি। পরীক্ষার যন্ত্রণায় হারিয়ে যেতে বসেছে শিশুর আনন্দময় শৈশব।

শিশুর খেলাধুলা, সংস্কৃতি চর্চা, গল্প, কবিতা, ছড়ার বই পড়া, ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণের মাধ্যমে জ্ঞানার্জন, নৈতিক শিক্ষাসহ ব্যবহারিক শিক্ষা- সব আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর পড়া, স্কুল, কোচিং- এসবই যেন শিশুর জীবন। পরীক্ষার ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষিত, নিরক্ষর সবার মাঝে ঐক্যবদ্ধ সুর। শিশুকে ভালোভাবে পাস করাতেই হবে। শিশুদের জন্য পরীক্ষা অনেকটা হাতুড়ে ডাক্তারের চিকিৎসার মতো, শরীরে পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা না করে যেমন লক্ষণ দেখে বা শুনে রোগীকে ওষুধ দেয়া হলে তাতে রোগীর বিপদের আশঙ্কা থাকে। আমাদের পরীক্ষা ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ কিছু প্রশ্ন খাতায় লিখলে ভালোভাবে পাস করা যায়। কিন্তু বলার যোগ্যতা, নৈতিক শিক্ষা অর্জন, পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার যোগ্যতা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণসহ ভবিষ্যতের আদর্শ নাগরিক হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যায় না। হারিয়ে ফেলছে তারা একজন আদর্শ নাগরিক হওয়ার উপযুক্ত যোগ্যতা।