খাদ্য উৎপাদনের বিষয়ে একবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বাসস্থানের এ পৃথিবীতে জায়গার ব্যবহার দিন দিন কমে যাচ্ছে। তাই আমাদের ভাবতে হচ্ছে, জায়গার অভাবে এ সমস্যার সমাধান কীভাবে হতে পারে? এ সমস্যার সহজ সমাধান হলো ‘মাইক্রোগ্রিন’ প্রযুক্তি। মাইক্রোগ্রিন চাষ করা খুবই সহজ। এটি যে কোনো জায়গায় বা পাত্রে সহজেই চাষ করা যায়; বিনিয়োগও কম। মাটির সঙ্গে সামান্য জৈব সার প্রয়োগ করে বীজ বপন করতে হয়। উৎপাদিত ফসল বাড়ির প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিচেন গার্ডেন হিসেবে বারান্দায় বা ছাদে এটি চাষ করা যায়। ট্রে-তে দুই ইঞ্চির মতো মাটির স্তর করে সেটাকে ভালো করে ভিজিয়ে (পানি যেন না জমে) তাতে বীজ ছিটিয়ে দিতে হয়। তারপর মাটির আরেকটি স্তর দিয়ে বীজগুলোকে ঢেকে রেখে দিতে হয়। বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার আগে আলোর প্রয়োজন হয় না। তবে অঙ্কুরিত হওয়ার পর ছায়াযুক্ত স্থানে রেখে দিতে হয়। এ সময় ট্রে-র আর্দ্রতা বজায় রাখতে সেটাকে প্লাস্টিক দিয়ে মুড়িয়ে রাখা হয়। সাধারণত অঙ্কুরিত হওয়ার এক সপ্তাহ থেকে বিশ দিনের মধ্যেই এটি খাওয়ার উপযোগী হয়ে ওঠে। চারায় যখন দুটি করে পাতা গজায়, তখনই সেটা হয় মাইক্রোগ্রিন। কিছু সবজি আছে এর চেয়ে বড় হলে আর কাঁচা খাওয়া যায় না। কয়েকটি ট্রে-তে মাইক্রোগ্রিন একসঙ্গে চাষ শুরু করলে কিছুদিন পরপরই এটি আহরণ করা যায়। চারাগুলোর গোড়া থেকে কাঁচি দিয়ে কেটে সরাসরি নেওয়া যায় সালাদের বাটিতে। মাইক্রোগ্রিনের জন্য বিশেষভাবে তৈরি ট্রে-তে পানি দিতে হয় নিচ দিয়ে। সরাসরি ওপর থেকে পানি দেওয়া হলে তাতে বীজ সরে গিয়ে অঙ্কুরোদগম না-ও হতে পারে। এক্ষেত্রে স্প্রে করে পানি দেওয়াটাই সবচেয়ে কার্যকর। মাইক্রোগ্রিন তৈরির জন্য বীজ সংগ্রহ করাটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দীর্ঘমেয়াদে যারা এটি চাষ করতে চান, তারা কমমূল্যে বেশি করে খোলা বীজ কিনে নিতে পারেন। মাইক্রোগ্রিন হচ্ছে অল্প বয়স্ক, ভোজ্য সবজি এবং ভেষজ। এটি অঙ্কুরোদগমের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাটা হয়; ডালপালা এবং কিছু পাতার জন্য অল্প বয়সে সংগ্রহ করা হয়। এটি একটি নরম সবজি, খুবই সুগন্ধযুক্ত এবং পুষ্টিকর। অনেক ধরনের গাছপালা এত দ্রুত অঙ্কুরিত হয় যে, রোপণের পর এক সপ্তাহের জন্য তাজা মাইক্রোগ্রিন উপভোগ করা যায়। মাইক্রোগ্রিন ব্রোকলি প্রায় দশ দিনের মধ্যে কাটা যায়। কাঁচা ব্রোকলি পাতার স্বাদ বাঁধাকপির স্বাদের মতো এবং যে কোনো মাইক্রোগ্রিনের চেয়ে সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যকর। বাঁধাকপি বীজের জাত সংগ্রহ করে সহজেই মাইক্রোগ্রিন বাড়ানো যায়। এর অপরিণত পাতাগুলো চকচকে এবং ডাল-পালাগুলো লাল, বেগুনি বা গোলাপি হতে পারে। মাইক্রোগ্রিন মূলা সবচেয়ে দ্রুত এবং সহজে জন্মানো যায়। এর বীজ বড়, ব্যবহার করা সহজ এবং দ্রুত
অঙ্কুরিত হয়। মাইক্রোগ্রিন মূলার ট্রে সাত দিনের মধ্যে খাওয়ার জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠে। ছোট সবুজ শাকগুলো সহজেই সালাদে ব্যবহার করা যায়।
মাইক্রোগ্রিন চাষের উদ্দেশ্য ভরপেট খাওয়া নয়- ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করা। কেননা, সাধারণ সবজিতে যে পরিমাণ পুষ্টি পাওয়া যায়, মাইক্রোগ্রিনে তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি পাওয়া যায়। কারো কারো মতে, এ পুষ্টির পরিমাণ চারগুণ বেশি। পাশাপাশি এটি খাবারের স্বাদেও যোগ করে নতুনত্ব। আর এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোতে এটি বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকা কেজিতে। দেখতে সাধারণ হলেও এর মাধ্যমে শহরের সৌখিন লোকেরা পূরণ করে নিতে পারেন পরিবারের প্রতিদিনের সবুজ খাবার ও ভিটামিনের চাহিদা। এর জন্য নিজের বাড়ির ছাদ বা সরাসরি সূর্যের আলো না হলেও চলবে। দরকার শুধু এক চিলতে বারান্দা। মাইক্রো মানে ছোট আর গ্রিন বলতে এখানে গাছ বোঝানো হচ্ছে। মূলত ট্রে ভর্তি চারাগাছই হলো মাইক্রোগ্রিন। আর এই চারাগাছ এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ বয়সেই কাঁচা খেতে হয়। মাইক্রোগ্রিন হলো একটি ‘সুপার ফুড’। করোনা মহামারির পর এ ধরনের খাবারের চাহিদা বেড়েছে। এমনকি অনেক জায়গায়ই বহু মানুষ চাকরি ছেড়ে দিয়ে কৃষির পথে হাঁটছেন। এ পথে লাখ লাখ টাকা আয়ের কথা দাবি করেছেন অনেকেই। তবে ঐতিহ্যবাহী ফসল চাষ বাদ দিয়ে উচ্চ চাহিদাযুক্ত ফসল নির্বাচন করে নিলে লাভের অঙ্ক আরও বাড়তে পারে। এ ফসলের চাহিদা বাজারে খুবই বেশি। মুলা, সরিষা, মেথি, ছোলা, গম বা ভুট্টার মতো বীজ দিয়ে মাইক্রোগ্রিন চাষ করা হয়। বেশিরভাগ মানুষই অঙ্কুরিত বীজ খেতে পছন্দ করেন। এগুলো শরীরে বাড়তি পুষ্টি জোগায়। মাইক্রোগ্রিনের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে এবং বাজারেও এর ভালো দাম পাওয়া যাচ্ছে।
মাইক্রোগ্রিনের চাষ একই সঙ্গে সহজ ও টেকসই। সবার আগে ভার্মিকম্পোস্ট দিয়ে ট্রে ভরিয়ে দিতে হয়। তারপর ঘন ও সারিবদ্ধভাবে বীজ বপন করতে হয়। এরপর সামান্য পানি স্প্রে করে অঙ্কুর প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। কয়েক দিনের জন্য ট্রেগুলো অন্ধকারে রেখে দিতে হয়। তৃতীয় দিনের পর থেকে সেগুলোকে সূর্যের আলো দেওয়া হয়। সাত থেকে আট দিনের মধ্যে সেগুলো নির্দিষ্ট উচ্চতা ছুতে পারে। তারপর অর্ডারের ওপর নির্ভর করে ফসল তোলা হয়। রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশে প্রায় সব জায়গায় মাইক্রোগ্রিন গজানো সম্ভব বলে সেগুলো একইসঙ্গে চাষিদের আয় বাড়াতে এবং বেড়ে চলা জনসংখ্যার পুষ্টির প্রয়োজন মেটাতে সহায়ক হতে পারে। আমাদের দেশে মাইক্রোগ্রিন নিয়ে খুব বেশি প্রচারণা না থাকার পেছনে অন্যতম
কারণ হলো এটিকে ব্যয়বহুল মনে করা। তবে রাজধানীতে যারা শখের চাষি তাদের অনেকেই জানেন, বীজ কেনা ছাড়া মাইক্রোগ্রিনে খরচ বলতে আর কিছু নেই। আর সেই বীজের দাম সৌখিন চাষিদের জন্য আহামরি কিছু নয়। বরং এটি হতে পারে দারুণ এক সবুজ বিনোদন। বীজ থেকে ট্রে-তে ছোট ছোট চারাগাছ গজিয়ে উঠতে দেখে তারাও দেখা যাবে কৃষিতে আগ্রহী হচ্ছে।
পুষ্টিতে ভরপুর এমন উদ্ভিদকে সুস্বাদু ‘সুপারফুড’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। ছোট এবং সীমাবদ্ধ পরিবেশে সহজে এমন উদ্ভিদ চাষ করা সম্ভব। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা ‘নাসা’ মহাকাশ অভিযানে মাইক্রোগ্রিন চাষ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আসছে। দীর্ঘ অভিযানের সময় মহাকাশচারীদের জন্য যথেষ্ট পুষ্টি নিশ্চিত করাই এ উদ্যোগের উদ্দেশ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশে বেশ কয়েক দশক ধরে সালাদের বিশুদ্ধ উপাদান হিসেবে মাইক্রোগ্রিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। ভারতের শহরাঞ্চলের রেস্তোরাঁর খাদ্য তালিকায়ও এর প্রচলন বাড়ছে। রেস্তোরাঁয় লাল, সাদা ও গোলাপি মুলার বৈচিত্র্য রয়েছে। আছে সূর্যমুখী ফুল, মটরের অঙ্কুর, ব্রকোলি, বাঁধাকপি, লাল অ্যামরাস্থাসও। নিজের তৈরি গ্রিনহাউস ও বাসার বারান্দায় সেসব চাষ হয়। জায়গাটি দশ বর্গমিটারের বেশি নয়। বীজ বপন থেকে শুরু করে বিতরণ পর্যন্ত এর সব কাজই একটি পরিবার সামলাতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকেও এই প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। আমাদের রফতানি বাণিজ্যে যেসব পণ্য সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে, তার মধ্যে এটি একটি। বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গীতে মাইক্রোগ্রিন উৎপাদন শুরু করলে সেটি অসম্ভব কিছু নয়। বিভিন্ন দেশে এ সবজির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কারণ এটি যাবতীয় রাসায়নিক সারমুক্ত ও সাধারণ সবজির চেয়ে বেশি পুষ্টিসমৃদ্ধ। মাইক্রোগ্রিন সম্ভাবনাময় খাত। বিশ্ববাজারেও এর চাহিদা ব্যাপক। কেউ যদি বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এটি উৎপাদনে উৎসাহী হয়, সরকার অবশ্যই সহযাগিতা করবে। মাইক্রোগ্রিন শুধু বিদেশেই নয়, আমাদের দেশেও ব্যবসার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে আমরা কি পরি না সফল হতে?