ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ছোটদের বড় লেখক বন্দে আলী মিয়া

সোহেল বীর
ছোটদের বড় লেখক বন্দে আলী মিয়া

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী বন্দে আলী মিয়া একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, চিত্রকর, গীতিকার, নাট্যকার ও শিশুসাহিত্যিক। তার কবিতায় ফুটে ওঠে গ্রামীণ বাংলার রূপ-রস-গন্ধে ভরা প্রকৃতির এক অনন্য চিত্র। তার সর্বাধিক পঠিত ও জনপ্রিয় একটি কবিতাণ্ড আমাদের গ্রাম। এ কবিতায় তিনি চমৎকারভাবে গ্রামের স্ব স্বরূপ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। ছোট্ট গ্রামে ছোট ছোট ঘরের মানুষের মাঝে এক অকৃত্রিম মেলবন্ধন। হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে পাড়ার সব ছেলের মিলেমিশে একসাথে খেলাধুলা আর পাঠশালায় যাওয়ার যে দৃশ্য তা ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতায় ধরা পড়েছে সাবলীলভাবে। কবির ভাষায়, আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,/থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।/পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,/একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই। গ্রাম আমাদের অস্তিত্বের শেকড়। অনাবিল সবুজ আর প্রকৃতির রং দিয়ে লেখা গ্রামখানি মা-মাটির কথা মনে করিয়ে দেয়। গ্রামের আলো-বায়ুতে রয়েছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি। আর এই আলো-বায়ুতে বেড়ে ওঠে প্রতিটি প্রাণ। কবি লিখেছেন, আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,/আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ। ছোট এই গ্রামে মাঠভরা ধান, জলভরা দিঘি, আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড় সবাই যেন আত্মীয়, মিলেমিশে একই গ্রামে তাদের বসবাস। কোনো হিংসা নেই, কোনো মারামারি হানাহানি নেই। সবাই সবার আপন। কবিতায় এভাবেই একটি গ্রামের প্রকৃতির অনন্য চিত্র তুলে ধরেছেন কবি বন্দে আলী মিয়া- মাঠভরা ধান আর জলভরা দিঘি,/চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি।/আমগাছ, জামগাছ, বাঁশঝাড় যেন,/মিলে মিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন। ‘আমাদের গ্রাম’ কবিতাটি শুধু কবির গ্রাম নয়, এ যে আবহমান বাংলার গ্রামের প্রকৃত দৃশ্য। এই কবিতাটি যেমন আমাদের সামনে একটি গ্রামের স্বরূপ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছে, তেমনিভাবে শিশুদের জন্য শিক্ষণীয় একটি কবিতা। বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল, বরেণ্য কবি বন্দে আলী মিয়া বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও সমানতালে লিখেছেন। শিশুদের জন্য তিনি নিরলস সাহিত্য চর্চা করেছেন। তার লেখায় বাংলা শিশুসাহিত্য পেয়েছে নতুন এক মাত্রা। ‘চোর জামাই’, ‘মেঘকুমারী’, ‘বোকা জামাই, ‘ডাইনী বউ’, ‘রূপকথা’, ‘কুঁচবরণ কন্যা’, ‘শিয়াল পন্ডিতের পাঠশালা’ ও ‘সাত রাজ্যের গল্প’ তাঁর উল্লেখযোগ্য শিশুতোষ গ্রন্থ। তার একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হচ্ছে- পাখি। এ কবিতায় পাখির প্রতি একটা শিশুর গভীর মমত্ত্ববোধ ও ভালোবাসা যেমন একদিকে ফুটে উঠেছে, তেমনি অন্যদিকে খাঁচা নয় পাখির কাছে তার স্বাধীনতা হলো উন্মুক্ত স্থান, খোলা আকাশ। প্রত্যেক প্রাণিই স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায়। আবার পাখি খাঁচা ছেড়ে চলে যাওয়ায় শিশুমনে যে গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, পাখির জন্য অশ্রুবিসর্জন দেয় সেরকম একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ও ফুটে ওঠে ‘পাখি’ কবিতায়- খাঁচার দুয়ার আলগা পাইয়া উড়ে গেছে পাখি বনে,/ছোট কালো পাখি উড়ে গেছে দূর নীল নভ অঙ্গনে।/শূন্য খাঁচাটি অনাদরে হোথা পড়ে আছে এক ধারে,/খোকা বসি পাশে অশ্রুসজল চোখ মোছে বারে বারে। কিংবা, এত ভালোবাসা, এত যে সোহাগ, পোষ তবু মানে নাই,/খাঁচার প্রাচীরে পাখা ঝাপটিয়া, পথ খুঁজিয়াছে তাই।/খোকা চায় পাখি, পাখি চায় বন-স্বাধীন মুক্ত প্রাণ,/কণ্ঠে তাহার জাগে ক্ষণে ক্ষণে নীল আকাশের গান। [পাখি]। বহুমাত্রিক লেখক বন্দে আলী মিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের পাবনা জেলার রাধানগর গ্রামে। পিতা মুন্সী উমেদ আলী মিয়া ও মাতা নেকজান নেসা ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। বাবা-মায়ের ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণায় তিনি সাহিত্যের উচ্চাসনে আরোহন করতে সক্ষম হন। কর্মজীবনে তিনি প্রথমদিকে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। তার কলকাতা যাপনের সময় বন্দে আলী মিয়া কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য লাভ করেন। সে সময় বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানিতে তার রচিত পালাগান ও নাটিকা রের্কড আকারে কলকাতার বাজারে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরবর্তীতে প্রথমে ঢাকা বেতারে ও পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেন। রেডিওতে চাকরি করার সময় তিনি ‘গল্পদাদু’ নামে শিশুদের কাছে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। কারণ, সে সময় ছোটদের জন্য রেডিওতে প্রচারিত হতো ‘সবুজ মেলা’ নামে একটি চমৎকার অনুষ্ঠান। কবি শিশুদের কাছে অনুষ্ঠানটিকে আরও আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত করতে শিশুদের উপযোগী গল্প লিখে তা শুনাতেন। আর এভাবেই বেতারে প্রচারিত ‘সবুজ মেলা’ অনুষ্ঠানটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল।

সাহিত্যান্ত প্রাণ কবি বন্দে আলী মিয়া কবিতায় গ্রামীণ কণ্ঠস্বর, পল্লির কবি ও প্রকৃতির কবি। সাহিত্যে স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও পদকে ভূষিত হয়েছেন। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।

তার সাহিত্য প্রতিভার জন্য তৎকালীন সরকার তাকে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৭৮ সালে তিনি রাজশাহীর উত্তরা সাহিত্য মজলিস পদক ও পুরস্কার লাভ করেন। সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৮৮ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৭৯ সালের ২৭শে জুন কবি বন্দে আলী মিয়া সবাইকে কাঁদিয়ে চিরতরে চলে যান, রাজশাহীতে তার মৃত্য হয়। পল্লী ও প্রকৃতির কবি, ছোটদের বড় এই লেখক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও তার অমর কীর্তি কবিতা, গল্প, গান বেঁচে থাকবে আমাদের মাঝে। সাহিত্যকর্মের মাঝেই তিনি টিকে থাকবেন। আমরা প্রিয় এই কবিকে স্মরণ করি ও বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।

লেখক: কবি, গল্পকার ও ফার্মাসিস্ট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত