আগুন সন্ত্রাসীদের বিচার হোক

আলী রেজা

প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাজনৈতিক আদর্শের উত্তরসূরি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশে মানবিক রাজনীতির একটি সমৃদ্ধ ধারা প্রতিষ্ঠা করে যাবেন- এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানুষকে আর যেন অগ্নিদগ্ধ হতে না হয়। আগুনসন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় এনে যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করাই হোক নতুন সরকারের প্রথম কাজ।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেল। অনেক জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা-সমালোচনা, কৌশল-অপকৌশল ও নির্বাচন বর্জনকারী জোটের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ উপেক্ষা করে যথাসময়ে যথানিয়মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্জনকারীদের কাছে সাজানো নাটক হলেও দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের রিপোর্ট অনুযায়ী এ নির্বাচন নিয়মতান্ত্রিক হয়েছে। বর্জনকারীদের নানা অভিযোগ সত্ত্বেও এবারের নির্বাচন বিতর্কিত হয়নি। বিএনপিবিহীন নির্বাচনে উত্তাপ কম ছিল বলা গেলেও এবার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব খুব একটা ছিল না।

নিবন্ধিত বেশিরভাগ দল অংশগ্রহণ করার ফলে নির্বাচন আইনগতভাবে বৈধ বা নিয়মতান্ত্রিক হয়েছে। নির্বাচন পরবর্তী আনুষ্ঠানিকতা শেষে নতুন সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রের সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মেই পরিচালিত হবে। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছে যেসব সাধারণ মানুষ তাদের কী হবে? তারা কোনো বিচার পাবে কি? দুর্বৃত্তরা শেষমেশ পার পেয়ে যাবে না তো? এ বিষয়ে জনমনে সংশয় আছে। সংশয়ের কারণ হলো, এসব ক্ষেত্রে দুষ্কৃতকারীরা নানাভাবে পার পেয়ে যায়। নির্বাচনের প্রায় আড়াই মাস আগে থেকেই (২৮ অক্টোবর ২০২৩) বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনকালীন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। আন্দোলনের অংশ হিসেবে তারা দফায় দফায় হরতাল-অবরোধ করেছে। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়ে নির্বাচনবিরোধী প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছে। লিফলেট বিতরণ করেছে। জনগণকে নির্বাচনবিমুখ করার জন্য গণসংযোগ করেছে। নানা কৌশল ও অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বাচনবিরোধীদের এসব আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণ সাড়া দেয়নি। সাড়া না দিলে কি হবে? হরতাল-অবরোধ ও সহিংসতার ঘটনায় জনগণের জান-মালের তো ক্ষতি হয়েছে।

যাত্রীভর্তি গণপরিবহনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। চলন্ত ট্রেনে অগ্নিসংযোগ করে জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এসব নৃশংস ঘটনার দায় কার? প্রকৃতপক্ষে দায় কেউ নিতে চায় না। পক্ষ-বিপক্ষ একে অন্যের কাধে দায় চাপিয়ে দেয়। কিন্তু নির্বাচন যারা বর্জন করেছে এবং নির্বাচনকে যারা প্রতিহত করতে চেয়েছে তারা নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার দায় এড়াতে পারে না।

নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবনে হামলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ পিটিয়ে মানুষ হত্যা এবং যানবাহনে অগ্নিসংযোগ করে সাধারণ যাত্রীদের পুড়িয়ে মারার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি নির্বাচন পরবর্তী সময়েও কিছু সহিংস ঘটনার খবর গণমাধ্যম সূত্রে পাওয়া গেছে। প্রতিপক্ষের কর্মী- সমর্থকদের ওপর হামলা হয়েছে। মিছিলে বোমা ফাটানো হয়েছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক এসব সহিংস ঘটনার শিকার সাধারণ মানুষগুলোর সঠিক বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ফলে যারা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সেই সব সাধারণ মানুষের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না। তারা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করার জন্য সেদিন ট্রেনযাত্রা করেনি। কেউ পরিবারের কাছে আসবে বলে কিংবা কেউ পরিবার থেকে বিদায় নিয়ে কর্মস্থলে আসবে বলে ট্রেনে চেপে বসেছিল। কারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল কিংবা কারা নির্বাচন বর্জন করল তা নিয়ে এসব সাধারণ মানুষের মাথাব্যথা ছিল না। তারা নিরেট খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ ছিল। ছিল অসহায় নারী ও নিষ্পাপ শিশু। নিজ নিজ গন্তব্যের দিকেই যাচ্ছিল তারা। এই নিরপেক্ষ লোকগুলোর জীবন কেড়ে নিয়েছে আগুনসন্ত্রাসীরা।

আগুনে পুড়ে মুহূর্তের মধ্যেই যারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, তাদের পরিবারের কান্না নিশ্চয়ই এখনো থামেনি। হয়তো থামবে না কখনো। তবে অগ্নিসংযোগকারী এসব দুর্বৃত্ত দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। সরকারকে দায়মুক্ত হতে হলে এসব নাশকতার বিচার করতে হবে। দলনিরপেক্ষ সাধারণ মানুষকে যারা পুড়িয়ে মেরেছে সেইসব দুর্বৃত্তদের বিচারের আওতায় এনে শাস্তির বিধান না করলে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই সদ্যগঠিত নতুন সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে দ্রব্যমূল্য কমানো ও সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা, কর্মমুখী শিক্ষা ও কর্মসংস্থান, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও প্রক্রিয়াকরণে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, শিল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা রক্ষা, নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা, সার্বজনীন পেনশনে সবাইকে যুক্ত করা, সন্ত্রাস প্রতিরোধ করা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা ও সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক চর্চার বিষয়ে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ ইশতেহারের সফল অর্থনৈতিক উন্নয়নকে অবশ্যই গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে বাস্তবায়ন হলে দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে এবং হবে। কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নই শেষ কথা নয়। সাধারণ মানুষের সমাজিক নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করতে হবে। এজন্য আইনের শাসনকে আরো শক্তিশারী করা দরকার। কোনো অপরাধী যেন আইনের হাত থেকে রেহাই না পায়। এ ব্যাপারে দল-মতের ঊর্ধ্বে উঠে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সবকিছু বিচার করতে হবে। দুষ্কৃতকারীরা শাসকগোষ্ঠীর আশ্রয়-প্রশ্রয় না পেলে তারা এমনিতেই নিস্তেজ হয়ে পড়বে। আবহমান কাল ধরে বাংলাদেশের মানুষ সমাজবদ্ধ জীবন যাপন করে আসছে। এক সময়ে রাষ্ট্রীয় আইনের মতোই সামাজিক আইন শক্তিশালী ছিল। সামাজিক অপরাধ ও সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করার ক্ষেত্রে সামাজিক সালিশ বা উঠান বৈঠকের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। অনেক ফৌজদারি বিষয় এমনকি খুনের মামলাও সামাজিক সালিশের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে নিষ্পত্তি হতো। বর্তমানে সামাজিক বিচার নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে গেছে। ফলে এখন সামাজিক আইনও ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছে। সামাজিক সালিশের মাধ্যমে মানুষ এখন যে কোনো সংকটে রাষ্ট্রীয় আইনের আশ্রয় নেয়। এ কারণে রাষ্ট্রকেই এখন মানুষের সব ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য এগিয়ে আসতে হচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একই সমাজের মানুষ নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছিল।

তাদের মধ্যে সহিংস ঘটনাও ঘটেছে। আইনের আশ্রয় নিতে গেয়ে অনেকে মামলায় জড়িয়ে গেছে। ফলে এই বিভক্তির রেশ কাটতে সময় লাগবে। তবে আইনি পর্যায়ে চলে যাওয়ার ফলে নাশকতার মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া প্রলম্বিত হতে পারে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতার সুযোগে অপরাধী পার পেয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে ফেলতে পারে। নতুন সরকারের কাছে সাধারণ মানুষের আশু প্রত্যাশা হলো, যারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তারা যেন কোনোভাবেই পার পেয়ে না যায়। ৩০ লাখ তাজাপ্রাণ আর ২ লাখ নারীর সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাঙালি জাতির স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য সাধারণ মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যান্য অধিকারের প্রশ্ন আসে।

তাই জীবনের নিরাপত্তার মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত হলেই শুধু বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে । মানুষের জীবন যেখানে বিপন্ন, সেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। জীবন বিপন্ন হলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো মূল্য নেই। তাই জীবনের নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো আপস করা চলবে না। সব ধরনের নাশকতা ও অগ্নিসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। মানবতাবিরোধী রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে তা মানুষের জন্য মঙ্গলজনক হবে। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেছে। মানুষ আজো সুখী, সমৃদ্ধ ও ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে। একটি মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের মানবিক রাজনীতির পথ দেখিয়ে গেছেন। তার রাজনীতি ছিল শোষিত মানুষের জন্য। বাংলার মানুষের জীবন ও সম্পদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য বঙ্গবন্ধু সারাজীবন সব ধরনের নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। তার রাজনৈতিক আদর্শের উত্তরসূরি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে মানবিক রাজনীতির একটি সমৃদ্ধ ধারা প্রতিষ্ঠা করে যাবেন- এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মানুষকে আর যেন অগ্নিদগ্ধ হতে না হয়। আগুনসন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় এনে যথাযোগ্য শাস্তি নিশ্চিত করাই হোক নতুন সরকারের প্রথম কাজ।

লেখক : গবেষক, ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।