চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষা
মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ
প্রকাশ : ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে মানবসম্পদ উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে স্বল্পসময়ে বিপুল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করা সম্ভব। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি জড়িত। সেবামূলক জরুরি কাজেও তাদের অংশগ্রহণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এমনকি বিদেশে কর্মরত দক্ষ জনশক্তির একটি অংশ প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাগ্রহণকারী জনগোষ্ঠী। প্রযুক্তিবিদদের পেশাগত জ্ঞান, কর্মদক্ষতার ওপর নির্ভর করে দেশের উন্নয়ন কাজের মান ও গতিশীলতা। এমনকি তাদের সক্রিয় ভূমিকা গড়ে তোলে দেশের আর্থসামাজিক সমৃদ্ধি। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ এরই মধ্যে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করার লক্ষ্যে প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে এবং সেসব দেশ দ্রুত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায়, যে দেশে কারিগরি শিক্ষার হার যত বেশি, সে দেশের মাথাপিছু আয়ও তত অধিক। উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো দেশে অধিকসংখ্যক দক্ষ জনশক্তি থাকায়, সেখানকার মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু আয় অনেক বেশি। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম অনুমান করে, ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের কারণে কর্মচারীদের ৫০ শতাংশ ফের স্কিলিংয়ের প্রয়োজন হবে। এ সময় প্রয়োজনীয় দক্ষতার এক-তৃতীয়াংশ প্রযুক্তগত দক্ষতা নিয়ে গঠিত হবে, যা আজকের কাজের জন্য এখনো গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত নয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দ্বারা অর্জিত সুযোগগুলো কাজে লাগাতে এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দক্ষিণ কোরিয়া ১৯ থেকে ২৪ বছর বয়সের মধ্যে তার কর্মীবাহিনীর ৯৫ শতাংশকে আনুষ্ঠানিক কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রদান করেছে। জার্মানিতে এ হার ৭৫ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে ৫২ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এখনো ২০ শতাংশে কমে রয়ে গেছে, যদিও সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থীর ভর্তির হার ৩০ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষার প্রতি অবহেলার কারণে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে ক্রমেই ঘাটতি তৈরি হচ্ছে, বাড়ছে বেকারত্বের হার। আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সম্ভাবনাময় তরুণসমাজ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি কার্যক্রম অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে। অদক্ষ জনশক্তি প্রেরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণও হ্রাস পাচ্ছে। অথচ বেশিসংখ্যক মধ্যস্তরের কারিগরি শিক্ষা গ্রহণকারী প্রশিক্ষিত জনশক্তি প্রেরণ করা গেলে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় অনেক বেড়ে যেতে পারে, দেশ মুক্তি পেতে পারে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে। দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতির সহায়ক শক্তি হিসেবে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে কারিগরি শিক্ষার বিকাশ জরুরি হলেও তা অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে আছে। শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বের কথা বার বার উচ্চারিত হলেও কার্যত সরকারি উদ্যোগ সেভাবে পর্যাপ্ত নয়। এমনকি সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষাগ্রহণরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা উন্নত বিশ্বের তুলনায় অনেক কম। দেশে সরকারি ও বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৫ শতাধিক। এর মধ্যে ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। এ ছাড়া প্রায় ২২০টি বেসরকারি পলিটেকনিক রয়েছে, যাদের নিজস্ব কোনো ভবন ছাড়াই ভাড়া করা ভবনে ক্লাস পরিচালনা করছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই কোনো উপযুক্ত ল্যাবরেটরি সুবিধা ও ব্যবহারিক ক্লাস পরিচালনার জন্য উন্নতমানের ওযার্কশপ নেই। ২০১৭ সালে কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ১৮৪টি প্রতিষ্ঠানকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করার নির্দেশ দিলেও অদ্যাবধি তা কার্যকর হয়নি। ২০০১ সাল থেকে প্রকৌশল ডিপ্লোমা কোর্স ৩ থেকে ৪ বছরে উন্নীত করা হলেও নতুন পাঠ্যক্রম অনুযায়ী প্রণীত পর্যাপ্ত মানসম্পন্ন পাঠ্যপুস্তক সরবরাহের ব্যবস্থা করা যায়নি। প্রকৌশল ডিপ্লোমা পাঠ্যক্রমে শতকরা ৬০ ভাগ ব্যবহারিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হলেও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের অভাবে ব্যবহারিক ক্লাস পরিচালনায় বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে শিক্ষার্থীকে পর্যাপ্ত ব্যবহারিক জ্ঞান ছাড়াই প্রকৌশল ডিপ্লোমা সনদ নিয়ে বাস্তব জীবনে প্রবেশ করে কর্মক্ষেত্রে নানারূপ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে শিক্ষক-স্বল্পতা, অপর্যাপ্ত এবং পুরোনো যন্ত্রপাতি, মানহীন পাঠ্যপুস্তক নিয়ে কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থার আশানুরূপ বিকাশ ঘটানো সম্ভব হয়নি। ফলে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের সম্ভাবনা অনেকটা হতাশায় পর্যবসিত হচ্ছে। দেশের উন্নয়নের ধারা সঠিকভাবে পরিচালনার জন্য স্নাতক প্রকৌশলীর পাশাপাশি নির্ধারিত আনুপাতিক হারে মধ্যস্তরের কারিগরি ডিপ্লোমা প্রকৌশলী এবং দক্ষ জনশক্তি বিশেষ প্রয়োজন। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এই তিন ধরনের পেশাজীবীর গ্রহণযোগ্য অনুপাত বিবেচনায় বাংলাদেশে স্নাতক প্রকৌশলীর অনুপাতে ডিপ্লোমা প্রকৌশলী রয়েছে অনেক কম। অথচ স্নাতক প্রকৌশলীদের কর্মপরিকল্পনাকে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্তসংখ্যক দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত ডিপ্লোমা প্রকৌশলী ও জনবল কাঠামো।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একটি প্রযুক্তিগত বিষয়, এসএসসি (ভোকেশনাল) এবং সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রসার ঘটানো। ২০১৪ সালে প্রথম ধাপে ১০০ উপজেলায় ১০০টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের মেয়াদ তিনবার বাড়িয়ে এখন পর্যন্ত ৭০টি প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। ২০১৯ সালে শুরু হওয়া ‘বিদ্যমান ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধি’ প্রকল্পটিও ২০২১ সালের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত করা যায়নি। ২০১৮ সালে ২৩টি জেলায় পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য গৃহীত প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত ৩ বছরে শেষ হয়নি।