ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাকার দিনকাল এবং নাগরিক জীবন

অলোক আচার্য
ঢাকার দিনকাল এবং নাগরিক জীবন

একটি তিলোত্তমা শহর ক্রমেই যখন বসবাসের অনুপযুক্ত হয়, তখন বুঝতে হবে সেই শহর ঘিরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এবং বহুমুখী দূষণে বিপর্যস্ত অবস্থা রয়েছে। আমাদের রাজধানী ঢাকা পৃথিবীতে বসবাসের অনুপযুক্ত শহরের তালিকায় ক্রমেই ওপরের দিকে উঠে আসছে। যখন এই শহর বসবাসের জন্য অনুপযুক্তের তালিকায় প্রথম স্থানে আসে- তখনও এই শহরে মানুষ বসবাস করবে, করতে হবে। বায়ুদূষণ পৃথিবীর বহু জনাকীর্ণ দেশেরই মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে।

দখল-দূষণে রাজধানী আজ বিপর্যস্ত। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, আলোদূষণ, মাটিদূষণ এসব দূষণেই ঢাকা মারাত্মক অবস্থা ধারণ করছে। একটির সমাধান করতে গেলে আরেকটি সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। ঢাকার বায়ুদূষণ ক্রমেই মারাত্মক আকার ধারণ করছে। সম্প্রতি গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৩ সালের ১৭৩টি শহরের মধ্যে জিম্বাবুয়ের হারারে’র সঙ্গে যৌথভাবে ১৬৬তম অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এটি সূচকে সপ্তম সর্বনিম্ন বাসযোগ্য শহর হিসেবে অবস্থান করছে। জীবনযাত্রার ব্যয়ের দিক থেকে টরন্টো, ক্যালগারি, মন্ট্রিল ও লিসবনের মতো শহরগুলোর কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে ঢাকা। এটি এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর। গত নভেম্বরে ব্রিটিশ ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বিশ্বব্যাপী জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে তাদের সর্বশেষ জরিপ প্রকাশ করে। এই জরিপের জন্য, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ) ১৭৩টি শহরের ২০০টিরও বেশি পণ্য এবং পরিষেবাগুলোর ৪০০-এরও বেশি স্বতন্ত্র মূল্যের তুলনা করেছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরের তালিকার প্রথমে রয়েছে সিঙ্গাপুর (সূচক মান ১০৪)। আর সবার শেষে অর্থাৎ সবচেয়ে কম ব্যয়বহুল শহর হলো সিরিয়ার দামেস্ক (সূচক মান ১৩)। আর জরিপে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সূচক মান ৫৬। গ্লোবাল লাইভেবিলিটি ইনডেক্স ২০২৩-এ ১৭৩টি শহরের মধ্যে জিম্বাবুয়ের হারারে’র সঙ্গে যৌথভাবে ১৬৬তম অবস্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। এটি সূচকে সপ্তম সর্বনিম্ন বাসযোগ্য শহর হিসেবে অবস্থান করছে। তবে দামেস্ক কম ব্যয়বহুল শহর হলেও বিশ্বব্যাপী বসবাসযোগ্যতার র?্যাংকিংয়ে নিচে অবস্থান করছে (১৭৩তম স্থান)।

অপরদিকে ঢাকা একদিকে যেমন ব্যয়বহুল শহর ঠিক তেমনি বসবাসেরও অযোগ্য। বলা যায়, ঢাকা এখন বহুমুখী সমস্যায় ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে বার বার উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও কোনোটারই সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় সমস্যাগুলো এখন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। এগুলোর তালিকা তৈরি করলে অনেক লম্বা হবে এবং কোনটির আগে কোনটি সমাধান করা হবে, তা নিয়েই ভজঘট লেগে যাবে।

এসব সমস্যা কার্যত এই শহরটাকে অকার্যকর করে ফেলছে। এই শহরে থাকা মানুষগুলো প্রতিদিন সমস্যা নিয়েই বাসা থেকে বের হচ্ছে আবার সমস্যার মাঝেই বাড়ি ফিরছে। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ জীবিকার সন্ধানে ঢাকামুখী হচ্ছে। এদের অনেকেই আবার সেখানে স্থায়ী বসবাস করার জন্য চেষ্টা করছে। অনেক আগেই ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে মেগাসিটি হয়েছে। সেই জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে যেসব শহরের জনসংখ্যা ধারণক্ষমতা অতিক্রম করেছে এবং শহরটি ঢাকার মতো অপরিকল্পিত। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো এতে আমাদের প্রাণশক্তি গাছপালা কাটা যায় প্রচুর। গাছ কেটে ফেলার পর তা আর লাগানো হয় না। ফলে শহরটা একসময় শুধু কংক্রিটের জঞ্জাল হয়ে পরে থাকে। যেখানে গাছপালা নেই সেখানে কীট-পতঙ্গ পাখি নেই, ফলে সেখানে প্রাণ নেই। তারপরও রাজধানীমুখী হচ্ছে মানুষ। কারণ এক তথ্যে দেখা গেছে দেশের কর্মসংস্থানের অর্ধেক ঢাকায়। সুতরাং ঢাকায় যেতেই হবে এবং থাকতেই হবে। জনশুমারি ২০২২-এর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা উত্তর সিটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩১ হাজার মানুষ বসবাস করে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। জিডিপির এক-তৃতীয়াংশ আসে ঢাকা থেকে এবং সারা দেশের প্রায় অর্ধেক কর্মসংস্থান ঘটছে ঢাকায়। অথচ ঢাকায় ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা নেই। ২৫ ভাগ সড়কের স্থানে রয়েছে মাত্র ৮ ভাগ এবং ৫২ শতাংশ মোটরযানই চলাচলের অযোগ্য।

শহরের পরিণতি হয় ক্রমশ নিষ্প্রাণ। এই নিষ্প্রাণ শহর হওয়ার পরিণতি থেকে ঢাকাকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কীভাবে? কংক্রিটের জঞ্জাল সরিয়ে প্রচুর সবুজ বনায়ন করতে হবে। ঢাকার বাতাসও বিষাক্ত। প্রতিদিন সেখানে বসবাসরত মানুষ যে বাতাস দিয়ে ফুসফুস পূর্ণ করছে তাতে নানা ক্ষতিকর বিষাক্ত উপাদান রয়েছে। অতি নগরায়ণের চাপে প্রকৃতি তার স্বাভাবিক গতি হারাচ্ছে। নগরায়ণ দরকার কিন্তু তা হতে হবে পরিকল্পিত। আমাদের রাজধানীর মতো না। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে নগরায়ণ এগিয়ে চলেছে। বর্তমানে দেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শহর বা নগরাঞ্চলে বসবাস করছে এবং নগরবাসীর প্রায় ৩২ শতাংশই ঢাকায় বাস করে। রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে সমগ্র রাজউক এলাকায় বর্তমান জনসংখ্যা ২৬ মিলিয়ন এবং জনশুমারি-২০২২ অনুযায়ী ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকায় বিদ্যমান জনসংখ্যা প্রায় ১০ দশমিক ২৮ মিলিয়ন। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩৯ দশমিক ৩৫ হাজার এবং উত্তর সিটি করপোরেশনে বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৩০ দশমিক ৪৭ হাজার মানুষ বাস করে। একটা বিষয় স্পষ্ট, মানুষ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে, আবার শেষে সেই প্রকৃতির কোলেই ফিরে যেতে চাইছে। তাহলে উন্নয়নই যদি প্রথম থেকে পরিকল্পনামাফিক করা হতো তাহলে আজকে এই পরিণতি বরণ করতে হতো না। প্রকৃতি রক্ষা ব্যতীত যে আমাদের অস্তিত্ব থাকে না, এই সহজ সত্যটি আমরা প্রথমে বুঝতে পারলেও বুঝতে চাইনি। আজ যখন বুঝতে পেরেছি, তখন হয়তো অনেকটা দূরে সরে এসেছি। যদি এখই নিজেদের বাঁচাতে চাই তাহলে সবাই মিলে পরিবেশ রক্ষা করতেই হবে। তা রাজধানী হোক আর যেকোনো শহরই হোক। কারণ গ্রামগুলোও আজ আধুনিকতার নামে বিলাসিতার নামে গাছপালা উজাড় হয়ে দালাকোঠায় পূর্ণ হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই অপরিকল্পিত নগরায়ণের কার্যক্রম আজও থামেনি।

ঢাকার মানুষের জন্য আরেকটি বড় ঝুঁকি হলো দূষিত বায়ু। ডব্লিউএইচওর মানদ- অনুযায়ী, বিশ্বের যেসব দেশের শতভাগ মানুষ মাত্রারিক্ত বায়ুদূষণের মধ্যে বাস করছে তার একটি বাংলাদেশ। আর বলাবাহুল্য যে আমাদের দেশের অন্য শহরের তুলনায় রাজধানীর বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি। ঢাকার বাতাসে মাত্রারিক্ত ক্ষতিকর পদার্থ রয়েছে যা নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহের অভ্যন্তরে পৌঁছে নানা রোগের জন্ম দিচ্ছে। অথচ প্রতিদিন ঘর থেকে বের হয়েই বিষাক্ত বাতাস টানতে হচ্ছে এ শহরের মানুষকে। একদিকে ইট কাঠের শহর থেকে গাছের সংখ্যা একেবারে কমে যাওয়া অন্যদিকে ক্রমাগত বৃদ্ধিপাওয়া যানবাহনের ধোঁয়া, আশপাশের ইটভাটার ধোঁয়া এসব মারাত্মকভাবে বাতাসে ক্ষতিকর পদার্থের জন্ম দিচ্ছে। বায়ু দূষণের সঙ্গে নোংরা এবং পানের অযোগ্য পানির কথা না বললেই নয়। পানি মানুষের নিত্যদিনকার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান। অথচ সেই পানির এর অবস্থা। এর কারণ ঢাকার আশপাশের নদীগুলোকে আমরা প্রায় মেরে ফেলেছি। যেখান থেকে আমাদের পানি সরবরাহ হয়। নিজেদের পেতে রাখা ফাঁদে আজ নিজেরাই। বোতলজাত পানি নিরাপদ মনে করার কোনো কারণ নেই। মাঝে মধ্যেই এসব বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারের কীর্তিকলাপ ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। মাটি দূষণের কথা বাদই দিলাম। কারণ দূষণ হওয়ার মতো মাটিই ঢাকায় অবশিষ্ট নেই। সব জায়গায় বিল্ডিং গড়ে উঠেছে। পুকুর, জলা ভরাট করে এসব বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির হার সবচেয়ে বেশি ঢাকায়। অধিকাংশ ভবনই ঝুঁকিতে রয়েছে। রাস্তায় বের হলেই মৃত্যু থাবা মেলে আছে জেনেও বের হতে হয়। এতসব সমস্যা নিয়ে রাজধানী কতদিন তার নাগরিকের কাছে তিলোত্তমা নগরী হিসেবে থাকবে তা সময়ই বলে দেবে। এরমধ্যেই যান্ত্রিক শহরের খেতাব পেয়ে গেছে। মানুষই এখানে যন্ত্র। সেক্ষেত্রে রাজধানীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এবং মানুষের বসবাসের উপযুক্ত করে তোলার জন্য সঠিক পরিকল্পণা এবং তার বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প আমাদের হাতে নেই।

একটি শহর ক্রমাগত দখল ও দূষণে বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পরে। তার দায় সেই শহরের সবার এবং বিশেষভাবে যারা এই শহরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় তাদের। সেখান থেকে ফেরাতে হলে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে শহরের সৌন্দর্য বর্ধনে কাজ করতে হবে। মৃত একটি শহর বাঁচাতে দায়িত্ব রয়েছে সবার। পরিচ্ছন্ন নগরী গড়তে প্রয়োজন পরিচ্ছন্ন মানসিকতা। শহরটাকে নিজের ঘর মনে করতে হবে। নিজের ঘর আমরা যেভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখি, কোনোভাবেই নোংরা হতে দেই না, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে শহরকেও দেখতে হবে। শহর সুস্থ থাকলে সেই শহরের নাগরিকও সুস্থ থাকবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত