ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অবৈধ হাসপাতালে শিশুমৃত্যু

এত সব অনিয়ম কেন জানায়নি কর্তৃপক্ষ
অবৈধ হাসপাতালে শিশুমৃত্যু

আমাদের দেশে অনেক কিছুই ভুয়া বলে প্রতীয়মান হয়। আসল ভেবে যাকে মানুষ গ্রহণ করে, সে পরে নকল বলে প্রমাণীত হয়। আসল ও নকলের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে না পারার ব্যর্থতা কার- সেই প্রশ্নের জবার দেয়ার জন্য কোন কর্তৃপক্ষ রয়েছে, তাদের সম্পর্কে মানুষকে জানতে হবে। আমাদের সমাজে ভুয়া পরিচয়দানকারী অনেক পদ-পদবির লোক কোনো কোনো সময় ধরা পড়ে। ধরা না পড়া পর্যন্ত তিনিই আসল। ভুয়া পরিচয়দানকারী কয়জনকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শনাক্ত করতে পারে বা সেই কর্তৃপক্ষের সেই সক্ষমতা আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি প্রভাবশালী দেশের প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা হিসেবে পরিচয় দিয়ে ফায়দা হাসিল করার প্রয়াস যখন দেশের একটি সুশৃঙ্খল বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা ও একজন প্রকৌশলী চালান, তখন অনেক কিছুই ভুয়া পরিচয় দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া কখনো কখনো সম্ভব হয়। বাংলাদেশ কীভাবে সব সম্ভবের দেশে পরিণত হলো, সেই ভাবনাওটা মানুষের মনে এসে যায়। রোগাক্রান্ত মানুষকে সুস্থ করার মহৎ কাজটি করে থাকে হাসপাতাল। চিকিৎসাসেবার কাজে যারা সংশ্লিষ্ট থাকে তাদের মানুষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। আর সেই হাসপাতাল যদি মানুষের মৃত্যুপুরী হয়, তা হলে আর কিছু বলার থাকে না। তাও যদি আবার নিষ্পাপ শিশুসন্তান অকালে মারা যায়, তাহলে তো আফসোস করা ছাড়া আর কোনো কিছুই করার থাকে না।

রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র বাড্ডা এলাকায় অবস্থিত ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫ বছরের একটি শিশুর সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে চিকিৎসায় অবহেলা না কি অপচিকিৎসা না কি কুচিকিৎসায় শিশুটি অকালে প্রাণ হারাল, সেই জবাব কে দেবে। শিশু বয়সে খতনা করানো চিকিৎসকদের জন্য একটি সাধারণ বিষয়। এই কাজটি করতে চিকিৎসা শাস্ত্রের কোনো বিশেষায়িত পড়াশোনা করার দরকার নেই। রাজধানীর আশপাশের অনেক এলাকায় ‘হাজাম’ নামে পরিচিত এক শ্রেণির লোক আছেন তারা কোনো প্রকার অজ্ঞান না করেই চাকু দিয়ে খতনা করে দেন। ঘণ্টা খানেক পর শিশুটি খেলাধুলাও করতে পারে। আর যেসব ডাক্তার, নার্স ও সহায়ক কর্মী অপারেশন করার সময় সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন, তাদের প্রত্যেকের যোগ্যতার সনদ পরীক্ষা করা দরকার। যে চিকিৎসক অপারেশন করেছেন তিনি কী শিক্ষা অর্জন করে এমবিবিএস পাস করেছেন, সেটাও খুঁজে দেখা দরকার। মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে তামাশা কোনো দেশ কোনো সমাজ মেনে নেবে না। তাহলে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাত কেন এত অনিয়মের মধ্যে পরিচালিত হবে- সেই প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর হাসপাতালটি বন্ধের নির্দেশ দিয়ে তারা তাদের কাজ শেষ করেছে বলে হয়তো প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু দেশের মানুষ তো আর স্বস্তিতে নেই। কোন হাসপাতালের নিবন্ধন নেই, কোন হাসপাতাল ভুয়া, কোন ডাক্তার আসল ডাক্তার নন, তা কোনো রোগী কিংবা তাদের আত্মীয়স্বজনের পক্ষে যাচাই- বাছাই করা সম্ভব নয়। রোগাক্রান্ত মানুষ সুচিকিৎসার জন্য কোথায় যাবে, সেটা কে বলে দেবে। মূলত সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতালটি বন্ধের ঘোষণা এলো। হাসপাতালটিতে লাইসেন্সসহ জরুরি কাগজপত্র নেই। লাখ লাখ টাকার ভ্যাট ফাঁকির অভিযোগও রয়েছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ধন্যবাদ দেয়া উচিত শিশুটির পিতাকে। তিনি পুত্রশোক কাটিয়ে আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন। শিশু আয়ানের মৃত্যুতে তার বাবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রদত্ত লাইসেন্স দেখাতে ব্যর্থ হয়। এছাড়া দপ্তরের অনলাইন ডাটাবেজ পর্যালোচনা ও পরিদর্শনকালে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেখা যায়, ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নামে কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিকট নিবন্ধন/লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য কখনোই অনলাইন আবেদন করেনি। প্রতিষ্ঠানটি কোনো প্রকার আইনানুগ নিবন্ধন অথবা লাইসেন্স ব্যতিরেকে চিকিৎসাসেবা নির্মাণাধীন ভবনে পরিচালনা করে আসছে, যা সরকারের প্রচলিত আইনের পরিপন্থি। গত ৩১ ডিসেম্বর সুন্নতে খতনা করাতে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় আয়ানকে। এ সময় তাকে সম্পূর্ণ অ্যানেস্থেসিয়া দিয়ে খতনা করা হয়। পরে অপারেশনের কয়েক ঘণ্টা পরও জ্ঞান না ফেরায় আয়ানকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে আট দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ৭ জানুয়ারি দিবাগত মধ্যরাতে আয়ানকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। কী সাংঘাতিক ঘটনা। ভাবতেও কষ্ট হয়। ওই হাসপাতালটি আগামী দিনে কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটাও আন্দাজ করা সম্ভব নয়। অসম্ভবকে সম্ভব করে হয়তো হাসপাতালটি ভিন্ন নামে আবার চিকিৎসাসেবায় হয়তো ফিরে যাবে। মানুষ অজ্ঞতার কারণে আবার সেখানে চিকিৎসা নিতে যাবে। আবার হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তখন কী জবাব দেবে। তারা কী হাসপাতালকে মৃত্যুপুরী করবে নাকি মানুষের সুচিকিৎসালয়ে পরিণত করবে, সেই সিদ্ধান্তও নিতে হবে। অন্যথায় মানুষকে এভাবে বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত