ঢাকা ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইসরাইলি গণহত্যা : বিশ্বনেতাদের দুঃখজনক নীরবতা

জালাল উদ্দিন ওমর
ইসরাইলি গণহত্যা : বিশ্বনেতাদের দুঃখজনক নীরবতা

গাজায় নেমে এসেছে মানবতার চরম বিপর্যয়। নিরপরাধ মানুষের আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস কাঁদছে। গাজাবাসীর বড়ই দুর্ভাগ্য এই যে, তাদের আর্তচিৎকারে বিশ্বনেতারা কর্ণপাত করছেন না। ইসরাইলি বর্বরতা ও নিষ্ঠুর নির্যাতন থেকে নিরপরাধ এবং নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষদের বাঁচানোর জন্য বিশ্বনেতাদের কেউই এগিয়ে আসেনি। দেশে দেশে সাধারণ জনগণ এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ এবং যুদ্ধ বন্ধের দাবি জানালেও পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধানরা এই বিষয়ে নীরব। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত জাতিসংঘ এক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ। মুসলিম বিশ্ব, ওআইসি, আরব লীগ এবং জিসিসি সবাই আজ নির্বিকার। এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসমূহও নির্বিকার। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত এবং কানাডা নির্বিকার। পশ্চিমাবিশ্ব ইসরাইলের নির্যাতন থেকে ফিলিস্তিনের নিরাপরাধ জনগণকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি বরং ইসরাইলের পক্ষে কথা বলে এবং ইসরাইলকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে সাহায্য করে সেই নির্যাতনের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ৭৫ বছরেরও বেশি সময় ধরেই ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের আগ্রাসন ও নির্যাতন চলছে। যখন ইচ্ছা তখন, যাকে খুশি তাকে ইসরাইল হত্যা করছে। ইসরাইলের এই বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতায় কত ফিলিস্তিনি মারা গেছে, কত ফিলিস্তিনি আহত হয়ে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেছে, কত ফিলিস্তিনি দেশান্তরিত হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে বসবাস করছে আর কত ফিলিস্তিনি ইসরাইলি কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্টে বন্দি জীবন কাটাচ্ছে তার কোনো হিসাব নেই। এসবই তো বিশ্ববাসীর জানা-শোনা বিষয়। ফিলিস্তিনিদের জীবনের যেন কোনো মূল্য নেই। ইসরাইলের ইচ্ছাই সব। ইসরাইল যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ইসরাইলকে বাধা দেয়ার কেউ নেই। ফলে ইসরাইল হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। ইসরাইল তার দখলদারিত্ব এবং আধিপত্যকে টিকিয়ে রাখতে কিছুদিন পর পরই ফিলিস্তিনের ওপর হামলা শুরু করে। এ যেন ইসরাইলের রুটিন ওয়ার্ক। বর্তমানের হামলা ইসরাইলের সেই আগ্রাসনের ধারাবাহিকতারই অংশ মাত্র। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে নির্মূল করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমন করাই যে ইসরাইলের এই আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। দীর্ঘ বাস্তবতা প্রমাণ করে, এই আগ্রাসনেও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নির্মূল সম্ভব হবে না। বরং, তা আরো বেগবানই হবে। স্বীকার করতেই হবে, হামাসের উত্থানে ফিলিস্তিনের রাজনীতি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। ফিলিস্তিনের রাজনীতি এবং জনগণ এখন দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহ, অপরদিকে ইসলামপন্থি হামাস। ফাতাহর সাথে সম্পর্ক রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের। অপরদিকে হামাস হচ্ছে ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রের কট্টর বিরোধী। ফাতাহ ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশ্রস্ত্র সংগ্রাম পরিত্যাগ করেছে। অপরদিকে হামাস সশ্রস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করতে চায়। ফাতাহ ইসরাইলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে অপরদিকে হামাস ইসরাইলের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। ২০০৬ সালের ২৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিনের সংসদ নির্বাচনে হামাস মোট ১৩২টি আসনের মধ্যে ৭৬টি আসনে বিজয়ী হয় এবং সরকার গঠন করে। ফিলিস্তিনের নেতৃত্ব প্রথমবারের মতো ইসলামপন্থিদের হাতে চলে যাওয়ায় ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা হামাসকে বয়কট করে, ফিলিস্তিনের প্রতি সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেয় এবং ২০০৬ সালের ২১ ডিসেম্বর হামাসের নিয়ন্ত্রণাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য বন্ধের লক্ষ্য মার্কিন কংগ্রেসে প্যালেস্টাইনিয়ান এন্টি-টেররিজম অ্যাক্ট ২০০৬ নামের একটি বিল পাস করা হয়। এদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ফাতাহর সাথে ইসলামপন্থি হামাসের দ্বন্দ্ব সংঘাত দিন দিন বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় ২০০৭ সালের ১৪ জুন ইসরাইল ও পশ্চিমাদের ইন্ধনে মাহমুদ আব্বাস ইসলামপন্থি হামাস সরকারকে বরখাস্ত করে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে হামাস ঐদিনই গাজা দখল করে নেয়। সেই থেকে গাজায় চলছে হামাসের শাসন আর পশ্চিম তীরে চলছে ফাতাহর শাসন। আর ইসরাইল তখন থেকেই গাজাকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে, যা আজো অব্যাহত আছে। আর এটিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব অব্যাহতভাবে সমর্থন করে চলেছে। ফলে গাজা দীর্ঘদিন ধরেই একটি উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা বলে, ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদেরও তো আত্মরক্ষার অধিকার আছে। অথচ, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা কখনোই ফিলিস্তিনিদের আত্মরক্ষার অধিকারের কথা বলে না। ফিলিস্তিনে ইসলামপন্থিদের নির্মূল করে স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমন করাই ইসরাইল ও পশ্চিমাদের মূল লক্ষ্য। এজন্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হামাস সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরাইল বরাবরই হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে অভিহিত করে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কাছে তারা সংগ্রামী ও স্বাধীনতাকামী। যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিমা বিশ্ব এবং ইসরাইল এমন একটি ফিলিস্তিন চায়, যে ফিলিস্তিনের নেতত্বে থাকবে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের অনুগত। এ জন্যই হামাস নিয়ন্ত্রণাধীন গাজায় এই ভয়াবহ আগ্রাসন এবং হামাসকে নির্মূল করতে ইসরাইল আজ এত মরিয়া। তারা এর মাধ্যমে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার সংগ্রামকে চিরতরে নির্মূল করতে চায়। কিন্তু আগেই উল্লেখ করেছি, এর মাধ্যমে হামাসও নির্মূল হবে না এবং স্বাধীনতার আন্দোলনও নির্মূল হবে না। সেই ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ পশ্চিমারা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডকে অন্যায়ভাবে বিভক্ত করে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসরাইল তো ফিলিস্তিনিদের প্রতি দমন নির্যাতন ও আগ্রাসন চালিয়ে আসছে। যখন ইচ্ছা তখন আগ্রাসন চালিয়েছে, হত্যা করেছে, ইচ্ছামতো বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ফিলিস্তিনিদের বসতবাড়ি, যাকে ইচ্ছা তাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছে ইসরাইলের কারাগারে। ইসরাইলকে রক্ষার জন্য জাতিসংঘে যখন ইচ্ছা তখনই ভেটো প্রয়োগ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এত সব নির্যাতন এবং ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও, ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার আন্দোলন তো স্তিমিত হয়নি, বরং বেগবান হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের দখলদারিত্ব মেনে নেয়নি এবং স্বাধীনতার সংগ্রামও পরিহার করেনি। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই হামাস মোকাবিলা করেছে ইসরাইলের অব্যাহত নির্যাতন ও ষড়যন্ত্র, যাতে প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন যুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা। পক্ষান্তরে হামাসের ওপর ফিলিস্তিনি জনগণের সমর্থন অতিদ্রুত বেড়েছে। হামাসের ওপর যত নির্যাতন এসেছে, তারা তত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। গাজায় ইসরাইলের অন্যায় আগ্রাসনকে পৃথিবীর কোনো শক্তিই প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেনি। ভাবতে অবাক লাগে অমুসলিম দেশ বলিভিয়া যেখানে ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, সেখানে মুসলিম দেশ মিসর, আরব আমিরাত আর জর্ডানের নেতারা ইসরাইলের সাথে বজায় রেখে চলেছে পূর্ণ কূটনৈতিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। এই সব মুসলিম দেশের নেতারা বরাবরই ইসরাইলি বর্বরতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের মতোই নীরব। বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে নিয়োজিত জাতিসংঘ। কখনই ফিলিস্তিনের জনগণকে ইসরাইলের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। ইসরাইল যখনই ফিলিস্তিনে আগ্রাসন চালিয়েছে, তখনই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা ইসরাইলের পাশে দাঁড়িয়েছে। কারণ, ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের হয়েই কাজ করে। জাতিসংঘে যখনই ইসরাইলের এসব অন্যায় ও অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে তখনই যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রয়োগ করে সেই প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়েছে। জাতিসংঘকে ব্যবহার করে অন্যায়ভাবে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা তো ওরাই করেছিল আর তা করেছিল ইসরাইলের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল মুসলিম এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা এবং জাতিসংঘ ইসরাইলের নির্যাতন থেকে ফিলিস্তিনের মুসলমানদের রক্ষার জন্য এগিয়ে আসবে, তা বিশ্বাস করা স্রেফ বোকামি। একইভাবে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব থেকে কিছু আশা করাটাও বোকামি। তবে, মনে রাখতে হবে, ক্ষমতার দাপট আর সামরিক শক্তির জোরে পৃথিবীকে বেশি দিন শাসন করা যায় না। যদি সম্ভব হতো তাহলে গ্রিক, রোমান আর ব্রিটিশরা চিরদিনই পৃথিবীকে শাসন করত। জার্মান আর সোভিয়েত সাম্রাজ্যের কোনোদিনই পতন হতো না। ইসরাইল এবং যুক্তরাষ্ট্রও অপরাজেয় কোনো শক্তি নয়। এই চিরন্তন সত্যের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে ইসরাইলের উচিত আগ্রাসন, দখলদারিত্ব ও বর্বরতা চিরতরে বন্ধ করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করা। আর পশ্চিমাদের উচিত, তাদের এই পক্ষপাতিত্ব ও দ্বিমুখীনীতি পরিহার করা এবং স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখা।

লেখক: প্রকৌশলী এবং উন্নয়ন গবেষক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত