যুদ্ধের কৌশলগত পরিবর্তনে জেলেনস্কি ও পুতিন

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক আগ্রাসনের প্রায় দুই বছর হতে চলল। এখন পর্যন্ত কোনো এক পক্ষের সামরিক বিজয়ের কোনো আলামতই দেখা যাচ্ছে না। কোনো মীমাংসা ও যুদ্ধবিরতির লক্ষণও দৃশ্যমান নয়। কিয়েভ কিংবা মস্কো-দুইপক্ষের কেউই তাদের যুদ্ধলক্ষ্যের সঙ্গে আপস করতে চায় না। আবার সেই লক্ষ্যে কীভাবে তারা পৌঁছাবে, তারও পরিষ্কার কোনো পথ তাদের সামনে খোলা নেই। ২০২২ সালের শেষ দিকে যুদ্ধের ভরকেন্দ্র ইউক্রেনের দিকে হেলে গিয়েছিল। ইউক্রেনীয় বাহিনী সফল পাল্টা আক্রমণে উত্তরাঞ্চলের খারকিভে বিশাল আয়তনের ভূমি পুনরুদ্ধার করেছিল।

এ আক্রমণে দক্ষিণাঞ্চলের খেরসন থেকে রাশিয়া তাদের সেনাদের সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই রাশিয়া প্রতীকী তাৎপর্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ সোলেদার গত বছরের জানুয়ারি ও বাখমুত মে মাসে দখলে নেয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি, বিশেষ করে জনবল ক্ষয়ের বিনিময়ে রাশিয়া এই দুটি জয় অর্জন করে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ক্রেমলিন তার সংকল্প ও সক্ষমতার প্রদর্শন করে।

কিন্তু নতুন বছরের প্রথমদিনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার বক্তব্যে বলেন, ৩০ ডিসেম্বর রাশিয়ার বেলগ্রেড শহরে ইউক্রেনীয় বাহিনী যে হামলা চালিয়েছে, তার শাস্তি অবশ্যই তাদের পেতে হবে। পুতিনের এই হুমকি নিছক কোনো হুমকি নয়। ৩১ ডিসেম্বর ইউক্রেনের ৫০টি জায়গায় ড্রোন হামলা চালায় রাশিয়া। ১ জানুয়ারি হামলা চালায় ৯০টি স্থানে। কিন্তু সবচেয়ে তীব্র হামলার ঘটনা ঘটে ২ জানুয়ারি। এদিনের হামলায় ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাশিয়া এদিন হামলার জন্য তাদের হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কিনঝাল ব্যবহার করে। এখন পর্যন্ত জানা যায়নি, ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কতটা কার্যকরভাবে লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আঘাত করেছে।

ইউক্রেনের সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনি দাবি করেছেন, কিনঝাল ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করা হয়েছে। যদিও এর সপক্ষে তিনি কোনো তথ্য-প্রমাণ দেননি। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কিয়েভের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পেরেছে। জানা যাচ্ছে, ড্রোন হামলার জন্য রাশিয়া গেরান-২ ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। এটা ইরানি আত্মঘাতী ড্রোন শাহেদণ্ড১৩৬-এর রুশ সংস্করণ। বেলগ্রেড শহরে ড্রোন হামলায় কমপক্ষে ২১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে চার শিশুও রয়েছে। আহত হয়েছেন ১১১ জন, তার মধ্যে ১৭ শিশু। সেখানে যারা হতাহত হয়েছেন, তাদের সবাই বেসামরিক নাগরিক। কোনো সামরিক স্থাপনায় হামলা হয়নি। রাশিয়ার একজন সেনাও নিহত হননি। ২ জানুয়ারি বেলগ্রেডে আরেক দফা হামলা চালায় ইউক্রেন। এবার অবশ্য খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতির কথা শোনা যায়নি। এদিনে দোনেৎস্ক অঞ্চলেও হামলা হয়। এ দফায়ও বেসামরিক লোকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। জাতিসংঘে নিযুক্ত রাশিয়ার দূত ভ্যাসিলি নিবিনজিয়ার তথ্যমতে, বেলগ্রেড স্কেটিংয়ের মাঠ, ক্রীড়াকেন্দ্র ও বিশ্ববিদ্যালয়েও হামলা চালানো হয়েছে। অনেক মাস ধরেই রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের নগর ও শহরগুলোর সামরিক স্থাপনার সঙ্গে জ্বালানি ও পানি সরবরাহ ব্যবস্থার মতো লক্ষ্যবস্তুতেও হামলা চালিয়ে আসছে। রাশিয়ার কিছু হামলার ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু হয়েছে আবাসিক ভবন, হোটেলসহ বেসামরিক স্থাপনা। এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে রুশরা দাবি করে আসছে, দুর্ঘটনাবশত আবাসিক ভবন বা হোটেলে হামলার ঘটনা ঘটেছে। অথবা তারা দাবি করে, ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় প্রতিরোধের মুখে পড়ে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র বেসামরিক স্থাপনায় গিয়ে পড়েছে। অথবা তারা দাবি করে, এসব ভবন ও হোটেল সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। অথবা বিদেশি সেনাদের আবাসস্থল ও গোয়েন্দা কেন্দ্র হিসেবে সেগুলো ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের হামলার ক্ষেত্রে ইউক্রেন সব সময় বলে আসছে যে রুশ বাহিনী বেসামরিক স্থাপনাকে লক্ষ্যবস্তু করেই হামলা করে। বেলগ্রেড হামলার পর রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে জরুরি সভা আয়োজনের দাবি করেছে মস্কোর দাবি ইউক্রেন বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা করেছে এবং হামলায় ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করেছে। রাশিয়া চেক রিপাবলিককে দায়ী করে বলেছে যে তারা ইউক্রেনকে যে আরএমণ্ড৭০ ভ্যাম্পায়ার মাল্টি পল রকেট লঞ্চার দিয়েছে, সেটা ব্যবহার করেই ইউক্রেন হামলা করেছে। রুশ নিউজ এজেন্সি তাস-এর খবর অনুযায়ী রুশ বাহিনী বেলগ্রেড অঞ্চলে ১৭টি রকেট ভূপাতিত করেছে। রুশরা বলছে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সরাসরি নির্দেশে এই হামলা পরিচালিত হয়েছে। এই হামলা করেছে ক্রাকেন রেজিমেন্ট। ক্রাকেন রেজিমেন্ট একটি বিশেষ বাহিনী, যেটি ইউক্রেনের সেনা গোয়েন্দা সংস্থার অধীনে পরিচালিত। কিরিল বুদানভ এখন বাহিনীটির নেতৃত্বে রয়েছেন। এদিকে জেলেনস্কি ক্রিমিয়া বিজয়ের প্রতিই মূল মনোযোগ দিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। দ্য ইকোনমিস্ট-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কি বলেছেন, সাময়িকভাবে রাশিয়ার দখলে থাকা ক্রিমিয়ায় ইউক্রেন এমন সফল অভিযান পরিচালনা করবে, যেটা বিশ্বের কাছে উদাহরণ হয়ে থাকবে এবং রাশিয়ার ভেতরে বিশাল প্রভাব পড়বে। যুদ্ধের কৌশলনীতি কী হবে, তা নিয়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ও সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনির দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য রয়েছে। জালুঝনি চান, ইউক্রেনীয় বাহিনী প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করুক, যাতে ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের ঘটনা অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। আর দোনেৎস্ক ও জাপারোঝঝিয়া অঞ্চলে রুশ বাহিনীর আগ্রাসনের প্রচেষ্টা রুখে দিতে চান তিনি।

অন্যদিকে জেলেনস্কি চান, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে অর্থ, অস্ত্র ও অন্যান্য সহযোগিতা অব্যাহত থাক। জেলেনস্কি এ ব্যাপারে খুব আত্মবিশ্বাসী যে তিনি রাশিয়ার নেতৃত্ব পর্যায়ে খুব ভালোভাবে ঝাঁকুনি দিতে পারবেন। এমনকি পুতিনকে ক্ষমতা থেকে ফেলে দিতে পারবেন বলেও মনে করছেন তিনি। ইউক্রেন নিয়ে তার মনোযোগ যতটা রাজনৈতিক, ততটা সামরিক নয়। জেলেনস্কি ভালো করেই জানেন, কূটকৌশল ছাড়া ক্রিমিয়ায় রাজনৈতিক সাফল্য পাওয়ার পথ নেই। সে কারণেই ইউক্রেন ব্রিটেন-ফ্রান্সের যৌথ উদ্যোগে তৈরি করা দূরপাল্লার অস্ত্রের ওপর নির্ভর করতে চাইছেন জেলেনস্কি। এদিকে যুদ্ধক্ষেত্রে বিশেষ করে বাখমুত ও আভদিভকা অঞ্চলে ধারাবাহিক পরাজয়ের মুখে পড়েছে ইউক্রেন। কিন্তু জেলেনস্কি রাশিয়ার শহরগুলোয় হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে একটা বাজি ধরতে চাইছেন। তিনি মনে করছেন, তার এই কাজে পশ্চিমা দেশগুলো অনুপ্রাণিত হয়ে তাকে বেশি বেশি সমর্থন দেবে। কিন্তু বাস্তবে সেটা হবে না বলেই মনে হয়। এ ধরনের হামলা ইউক্রেন ও দেশটির সমর্থকদের জন্য ভিন্ন ফল নিয়ে আসতে পারে। এবার রাশিয়া যেমন চেক প্রজাতন্ত্রের দিকে আঙুল তুলেছে। ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহের কারণে রাশিয়া চেক প্রজাতন্ত্রকে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা করতে পারে। এতে বড় পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা তৈরি হবে। রাশিয়া যদি নিজেদের সংযত রাখেও তবু এ ধরনের হামলা ইউক্রেনের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইউক্রেন যেভাবে রাশিয়ার শহরগুলোয় হামলা শুরু করেছে, তাতে ইউরোপ নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় পড়তে পারে। এতে পরিস্থিতি হাতের নাগাল থেকে ফসকে যাওয়ার আগে ন্যাটো তাড়াহুড়ো করে রাশিয়ার সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে ফেলতে পারে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ইউরোপের রাজনৈতিক রূপরেখাতেও পরিবর্তন আসছে। পোল্যান্ডের ক্ষেত্রে উত্তেজনা দেখা গেলেও ইউরোপের আর সব দেশের ক্ষেত্রে উৎসাহে ভাটা পড়তে দেখা যাচ্ছে। অনেক দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনও আসন্ন। রাশিয়ার শহরগুলোয় জেলেনস্কির হামলা ইউরোপে বড় পরিসরে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার যে ঝুঁকি তৈরি করল, তাতে ন্যাটোর দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর পক্ষে ভোটার টানা আরো কঠিন হয়ে যাবে। রাশিয়ার শহরে হামলা জেলেনস্কির আরেকটি বড় ভুল। এই বাস্তবতা ইউক্রেনকে ভবিষ্যতে পাল্টা আক্রমণে যেতে সমস্যায় ফেলবে। একই সঙ্গে রাশিয়ার দিক থেকে নতুন আক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করবে। এখন ক্রেমলিনের দিক থেকেও তাদের আক্রমণ অভিযানে অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। শিগগিরই বড় কোনো সফলতা আসবে, সে রকম কোনো নমুনা দেখা যাচ্ছে না। যাহোক, এই স্থিতাবস্থাকে ব্যবহার করে রাশিয়া এখন তাদের যুদ্ধ অর্থনীতি স্ফীত করতে পারে। উত্তর কোরিয়ার মতো মিত্রের কাছ থেকে আরো অস্ত্র আমদানিও করতে পারে। ১৪ ডিসেম্বর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার বার্ষিক ভাষণে বলেছেন, ইউক্রেনকে নাৎসিমুক্ত, নিরস্ত্রীকরণ ও নিরপেক্ষ রাষ্ট্র করার অভীষ্ট অর্জন না হওয়া পর্যন্ত শান্তি আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। ইউক্রেনকে সহযোগিতা দেওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তাতে যুদ্ধে আগামী বছর পুতিনকে হারানো যাবে, সেটা ভাবা ঠিক হবে না। কিন্তু আরো একটি বছর যদি এ রকম অচলাবস্থা চলতে থাকে, তাহলে ইউক্রেনের জন্য সেটা হবে একটা সুযোগ।

রাশিয়ার আক্রমণ ও ভূমি দখল প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাটাই এখন ইউক্রেনীয় বাহিনীর জন্য সবচেয়ে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হবে। এ ধরনের রক্ষণাত্মক অবস্থান নিতে পারলে ইউক্রেন নিজেদের সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার এবং যুদ্ধ শেষ করার জন্য নতুন কৌশল প্রণয়নের সময় পাবে। এ ধরনের কৌশল নিলে ইউক্রেন তাদের পরিকল্পনামাফিক পাঁচ লাখ নতুন সেনা নিয়োগ করা এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় পাবে। এর মাধ্যমে বয়সের ভারে ন্যুব্জ ও বিধ্বস্ত ইউক্রেনীয় বাহিনীতে নতুন প্রাণের সঞ্চার করা সম্ভব হবে। ইউক্রেনের ইউরোপীয় মিত্ররা এতে তাদের হাতে সময় পাবে। ইউক্রেনকে অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কী করা যাবে, তা তারা ভাবনাচিন্তা করতে পারবে। এই অর্থ ইউক্রেনের অর্থনীতি বাঁচিয়ে রাখার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় রসদ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থ ছাড় করলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের ওপরও চাপ তৈরি হবে। একই সঙ্গে ইউক্রেন এখন নিজেদের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উন্নয়ন ও উৎপাদনের চেষ্টা করছে, সে কাজও এগিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমা অস্ত্র কোম্পানিগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ শুরু করার চিন্তা করা হবে প্রথম পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপ নিতে পারলে ২০২৪ সালে নতুন আগ্রাসনে যেতে রাশিয়াকে বিরত রাখবে, যুদ্ধের হিসাব-নিকাশ নতুন করে কষতেও মস্কোকে বাধ্য করবে। বেশির ভাগ যুদ্ধের মতো ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসনও আলাপ-আলোচনার টেবিলে অবসান হবে। ২০২৪ সালে সেটা যদি নাও সম্ভব হয়, তার মানে এই নয় যে, মীমাংসার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা থেমে থাকবে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক