রোজায় পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে

আর কে চৌধুরী

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রধানমন্ত্রী নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের আসন্ন পবিত্র রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি মজুদবিরোধী অভিযান নিয়মিত পরিচালনার নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যাতে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের নিয়ে গত শনিবার টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে টুঙ্গিপাড়ার বাসভবনে নতুন মন্ত্রীদের নিয়ে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। মাহে রমজান কৃচ্ছ্র সাধনের মাস। এ মাসে মুনাফাখোরি মনোভাব কোনোভাবেই কাম্য নয়। কিন্তু চোরা নাহি শোনে ধর্মের কাহিনি প্রবচনের সার্থকতা প্রমাণ করে প্রতি বছর রমজানকে কেন্দ্র করে মুনাফাখোররা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রোজার দুই মাস বাকি থাকতেই রোজায় ব্যবহৃত বেশ কয়েকটি পণ্যসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা। ছোলার ডাল কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। বাজারে খেসারির ডাল প্রতি কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগে ছিল ৯৫ থেকে ১০০ টাকা। ডালের দাম বাড়ায়, বেড়েছে বেসনের দাম। এক মাসের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে মুগডালের। যা প্রতি কেজি ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশে বর্তমানে খোলা চিনি প্রতি কেজি ১৪৫ ও প্যাকেটজাত ১৪৮ টাকায় আর লাল চিনি বিক্রি হচ্ছে ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা। এমনিতেই গত দেড় বছরে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ব্যাপকভাবে। রোজার দুই মাস আগে খেজুর, ছোলা, ছোলার ডাল, বেসনের দাম আরেক দফা বৃদ্ধি উদ্বেগজনক। এর ফলে রোজায় ভোগান্তির সম্মুখীন হবেন রোজাদাররা। দেশে সারা বছর যত ছোলা বিক্রি হয় তার সিংহভাগ হয় রোজার মাসে। খেজুরের ব্যবহার রোজায় বেড়ে যায় বহুগুণ। এ বাড়তি চাহিদাকে মনে রেখে ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে রোজার সময় ইফতারে ব্যবহৃত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মুনাফাখোরদের সামাল দিতে নতুন সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা তাৎপর্যের দাবিদার। আমরা আশা করব, এ নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারের মন্ত্রীরা যা যা দরকার সবকিছুই করবেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণায় মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত ১১টি নিত্যপণ্যসহ বিভিন্ন সেবার মূল্য ১ বছরের ব্যবধানে সর্বনিম্ন ৭. থেকে সর্বোচ্চ ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে চাল, ডিম, মাংস, সবজি, ভোজ্যতেল, বিবিধ খাদ্যপণ্য, কোমল পানীয়, কাপড়, জুতা, জ্বালানি ও বাসাভাড়া। এ ছাড়া গৃহসামগ্রী, গণপরিবহন, বিনোদন ও শিক্ষা এবং বিবিধ পণ্য ও সেবাও রয়েছে এ তালিকায়। বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব পণ্য ও সেবার দাম বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ও বেড়ে গেছে। অথচ বাস্তবতা হলো, বিদ্যমান দেশীয় ও বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে মানুষের আয় মোটেই বাড়েনি। এ প্রেক্ষাপটে জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপস করে জীবিকা নির্বাহ করছে দেশের সিংহভাগ মানুষ। তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভাবিক। বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ায় দেশের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নিম্নআয়ের শ্রমজীবীরা অসহায়বোধ করছেন।

অনেকের অভিযোগ-দেশের ব্যবসায়ীরা পকেট স্ফীত করার বাইরে অন্য কিছু ভাবেন না; জনস্বার্থকে মোটেই গুরুত্ব দেন না। ব্যবসায়ীদের এহেন আচরণ ও কর্মকাণ্ড অযৌক্তিক, অমানবিকও বটে। এ অবস্থায় লোকঠকানো মানসিকতা পরিহার করে তেল, চিনিসহ সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য স্থিতিশীল রাখতে ব্যবসায়ী সমাজ আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে। করোনায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি তাদের জন্য আরেকটি সমস্যা। দেশে এত বড় বাজার, যা শুধু আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ‘ন্যায্যতার’ মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে তুলতে না পারলে দ্রব্যমূল্য কেন, কোনো কিছুই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সব কিছুর দাম বাড়ায় সংসার খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের পেছনে। চাহিদার সঙ্গে দাম যাতে না বাড়ে, সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো দৃশ্যত কিছু বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়ে থাকে। তবে আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এসব ব্যবস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। এটা স্পষ্ট যে, করোনা দুর্যোগে অনেকের আয়-রোজগার কমে গেছে, অনেকেই হয়েছেন কর্মহীন। এখনো বাজার স্থিতিশীল রাখতে সরকার নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির মাধ্যমে যাতে বাজারকে অস্থিতিশীল করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখার কথা জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন কর্মকর্তারা। অবশ্য এসব তৎপরতায় তেমন কোনো সাফল্য আমরা দেখি না। বাজার নিয়ন্ত্রণে টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিপণন, বাজার মনিটরিং ইত্যাদি যেসব পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, এগুলো যেন যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পরিবহন নির্বিঘ্ন রাখতে বিশেষ করে কৃষিপণ্যের সরবরাহে যাতে কোনো বাধার সৃষ্টি হতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এর বাইরে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বাজার পরিস্থিতি তদারকি অব্যাহত রাখতে হবে। পরিশেষে বলছি, কেন্দ্র থেকে স্থানীয় উৎপাদন ক্ষেত্র পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাও নজরদারির আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আমদানিকৃত ও দেশজ উৎপাদিত এই দুই ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখার ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে।

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক।