নদীকেন্দ্রিক পর্যটনে অপার সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ

এস এম মুকুল

প্রকাশ : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নদী হলো প্রাকৃতিক জলাধার। নদী সৌন্দর্য মানুষের মনকে অপার আনন্দে ভরিয়ে দেয়। নদীকে ঘিরেই বিশ্বের প্রতিটি শহর, বন্দর, গঞ্জ, বাজার প্রভৃতি গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের হাট-বাজারগুলো মূলত নদীকেন্দ্রিক। এর কারণ হলো মালামাল পরিবহন ও যোগাযোগের সহজমাধ্যম ছিল নদীমাতৃক বাংলার নৌকা। মালামাল পরিবহনে খুবই কম খরচে নৌকার জুড়িমেলা ভার। একসময় পালতোলা নৌকার শোভাচিত্র দেখা যেত বাংলাদেশের নদীগুলোতে। সময়ের বিবর্তনে সে স্থান দখল করেছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। প্রকৃতিপ্রেমিক প্রতিটি মানুষ নদীর সৌন্দর্যে অভিভূত হয়। তাই নদী আর মানুষের সম্পর্ক অনেক গভীর। নদীর প্রতি ভালো লাগার অনুভূতি প্রতিটি মানুষের মধ্যেই বিদ্যমান। এ কারণেই নৌ-ভ্রমণ বা নদীর তীরে বেড়াতে যাওয়া প্রজন্মের তরুণ-তরুণীদের কাছে অনেক প্রিয় ও পছন্দের বিষয়। বাংলাদেশের নদী মানে বাঙালির নিজস্ব জীবনধারার কিছু চিত্র। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নদী। বাংলাদেশ একটি নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের ছয়টি ভিন্ন ঋতুতে এই নদী নিজেকে মেলে ধরে নানা রূপে! পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ছাড়াও এদেশে রয়েছে অনেক অনেক ছোট বড় নদী। যেদিকে দুচোখ যায়, সেই দিকে দেখতে পাবেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদী। প্রত্যেকটি নদীর রয়েছে আলাদা আলাদা সৌন্দর্য। প্রত্যেকটি নদীর রয়েছে আলাদা আলাদা গল্পকথা। নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়নি এমন মানুষ কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কবি-সাহিত্যিকরা শুধু নদীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে রচনা করেছেন নানা ধরনের কবিতা এবং সাহিত্য সমাহার। আমরা জানি, সারা বিশ্বের মোট পর্যটন খাতের বিশাল অংশ আসে ক্রজশিপ, সৈকতসংলগ্ন পর্যটন কার্যক্রমসহ নানা জলজ আধার থেকে। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক বিন্যাস নদীকেন্দ্রিকতায় সমৃদ্ধ। অথচ তা নিয়ে আমাদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়ে না। প্রজন্মের মননশীলতার বিকাশ ও প্রকৃতিপ্রেম সৃষ্টি করতে হলে নদীকেন্দ্রিক পর্যটন গুরুত্বপূর্ণ। আবার পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হলে নদী সংরক্ষণেরও কোনো বিকল্প নেই। নদী পর্যটন গড়ে উঠলে প্রয়োজনের তাগিদেই নদী রক্ষার কার্যক্রম আরো সহজ, সুন্দর ও জোরালো হবে। ফলে নদী তীরবর্তী মানুষ এ খাতে বিনিয়োগ করে লাভবান হবেন। তখন তারা নদীর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন এবং নদী রক্ষায় এগিয়ে আসবেন। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের মধ্যে এ রকম ধারণা আছে, পর্যটন মানেই অবকাঠামো, তারকা হোটেল, রেস্তোরাঁ, বার-ড্যান্স ক্লাব ইত্যাদি। কিন্তু না, কোনো ধরনের অবকাঠামোর পাশাপাশি শুধু বাংলাদেশের নদীগুলোই যে পর্যটনের বিরাট উৎস সৃষ্টি হতে পারে, সে বিষয়ে মানুষ এখন সচেতন হয়ে উঠছে।

নদী পর্যটনের সুযোগ ও সম্ভাবনা অনেক। যান্ত্রিক সভ্যতার এই যুগে রিভার ট্যুরিজম পর্যটকদের প্রশান্তির ছোঁয়া দিতে পারে। বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হতে পারে বাংলাদেশের নদনদী, হাওর ও বিলকেন্দ্রিক স্পটগুলো। শুধু সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া এ ৭ জেলার সাত লাখ ৮৪ হাজার হেক্টর জলাভূমিতে ৪২৩টি হাওর নিয়ে হাওরাঞ্চল গঠিত। হাওরের পর্যটন এখন ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। তা ছাড়া সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কাপ্তাই, রাঙামাটি, সিলেট, কিশোরগঞ্জ, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, ভৈরব, খুলনা, বরিশাল, ভোলা, ঝালকাঠী, পিরোজপুর, পটুয়াখালীতে নৌপর্যটন-শিল্প গড়ে তোলার যথেষ্ট সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আকর্ষণ করতে এসব জায়গা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। বর্তমান সময়ে নদী পর্যটন সম্ভাবনাময় একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে বিভিন্ন দেশেই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পর্যটন খাত। লন্ডনের টেমস, ইতালির ভেনিস, মিসরের নীলনদ এসব নদীকেন্দ্রিক পর্যটনের অনন্য উদাহরণ মাত্র। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ নদীকেন্দ্রিক পর্যটনকে কাজে লাগিয়ে, অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেশী ভারতের কেরালা, জম্মু কাশ্মির কিংবা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মারিশাস প্রভৃতি দেশে নৌপর্যটন বেশ খাতি অর্জন করেছে। এসব দেশে রিভার ট্যুরিজমের জনপ্রিয়তা সহজেই চোখে পড়ার মতো। শুধু নদী, হ্রদ, এবং সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকাকে কেন্দ্র করে তারা তাদের পর্যটন শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। কেরালা, জন্মু কাশ্মীর কিংবা ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ার মতো আমাদের দেশেও রিভার ট্যুরিজমের চমৎকার আকর্ষণীয় স্পট রয়েছে- রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবান, খুলনা, বাগেরহাট সুনামগঞ্জ অঞ্চলে। বাংলাদেশের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ- সব দিকেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নদী ও নদীকেন্দ্রিক জনপদেও আছে পর্যটনের অপার সম্ভাবনা। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, নদীমাতৃক দেশ হলেও নদীকেন্দ্রিক পর্যটনে এখনো গড়ে ওঠেনি তেমন কোনো কাঠামো। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হবে নতুন মাত্রা। বাংলাদেশের অধিকাংশ শহর নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে রাজধানী ঢাকা, কীর্তনখোলা নদীর তীরে বরিশাল শহর, কর্ণফুলী নদীর তীরে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম অবস্থিত। এ ছাড়া প্রকৃতির অপরূপ সাজে সজ্জিত বাংলার গ্রামগুলোও নদীর স্পর্শ থেকে মুক্ত নয়, বরং গ্রামের কৃষিনির্ভর অর্থনীতিতে নদীর অবদান অপরিসীম। আমাদের এই তিলোত্তমা নগরী ঢাকাকে চারদিক থেকেই ঘিরে আছে চারটি নদী। বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা আর বালু। নদীর তীরের অপার সম্ভাবনা দেখেই মোঘলরা ঢাকাকে বেছে নিয়েছিলেন রাজকীয় জনপদ তৈরির জন্য।