দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ

মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে সবাই আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। যুদ্ধের সময় তেল, গ্যাস এর দাম বেড়ে যায়, এমনিতেই দাম বৃদ্ধি আবারও যদি বাড়ে তাহলে সেটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে। রমজানে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে তাই ভেজাল পণ্য ও মূল্যবৃদ্ধি কার্যক্রমের সঙ্গে সুযোগসন্ধানী জড়িত ব্যক্তিদের আটক এবং মোবাইল কোর্ট অথবা উপযুক্ত আদালতে বিচারকার্য সম্পন্নের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। শীতকালে সাধারণত শীতকালীন সবজি যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি ও ওলকপিসহ নতুন আলু, পেঁয়াজ, শিম, মুলা, টমেটো, গাজরের দাম কম হয়ে থাকে। এবার তার ব্যতিক্রম। কোনোভাবেই এসব সবজির দাম কমছেই না। বরং ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এগুলো দেশীয় সবজি হলেও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কথা বলে এগুলোর দাম তেল ও গ্যাসের সঙ্গে সমানতালে বাড়ছে। তবে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিরোধীদের দেওয়া হরতাল অবরোধ এবং সংসদ নির্বাচন পরবর্তী শৈত্যপ্রবাহ সবকিছু মিলিয়ে নিত্য পণ্যের দামে অস্থিরতা সরকার, অর্থনীতিবিদ ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা সবাইকে ভাবাচ্ছে। কীভাবে বাজারদর সাধারণ জনগণের নাগালের মধ্যে রাখা যায়, সেসব বিষয় নিয়ে আজকের লেখা। সামনে রমজান মাস আসছে। অল্পকয়েক দিন বাদেই মাহে রমজান মাস শুরু। এই মাসে কিছু পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। সেই সুযোগে রমজানে আবার মুসলিম নামধারী ব্যবসায়ীরা এবং দোকানদাররা জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দেয়। যদিও মুসলমানরা রমজান মাস এলে সারা বছরের পাপ মোচন করবে বলে কোমর বেঁধে নামে। রমজানের প্রথমভাগে মসজিদে জায়গা পাওয়া তো বেশ কষ্টসাধ্য। আসন্ন পবিত্র রমজানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘পবিত্র রমজান ঘনিয়ে আসছে, তাই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। কারণ, এই মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ানো উচিত নয়। বাজার পর্যন্ত উৎপাদিত কৃষি ও ভোগ্যপণ্য নানাবিধ কারণে পৌঁছানো সম্ভবপর হয় না। সেই অজুহাতে ও রাজনৈতিক সংকটের কারণ দেখিয়ে রমজানে বেশি পরিমাণে ব্যবহার হয়, এমন নিত্যপণ্যের দাম ব্যবসায়ীরা বাড়াতে পারে। তবে এই বাজার নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান কি কি আইন আমাদের দেশে আছে এবং কীভাবে প্রয়োগ করলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব তা বলার চেষ্টা করব।

বাংলাদেশে যেকোনো গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। গুজবে আবার একশ্রেণির মুনাফালোভী ব্যবসায়ী গুজব সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। যেমন লবণের ক্ষেত্রে সম্প্রতি আমরা তা দেখেছি। পেঁয়াজের ঝাঁজের কথা তো আমরা সবাই জানি। এখন শুরু হয়েছে করোনাভাইরাস ও রমজান মাস এলে বরাবরের মতো এবার নিত্য পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধির খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই মূল্যবৃদ্ধি ও মজুতদারি ঠেকাতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায় এবং বিদ্যমান আইন ভোক্তা সংরক্ষণ আইন ও স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট কী বলে, তা জেনে নেওয়া যাক।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ বলা হয়েছে, স্পেশাল পাওয়ারস অ্যাক্ট, ১৯৭৪-এর ধারা ২৫সি বা অন্য কোনো আইনে উল্লিখিত Adulteration বা ভেজাল। ‘ভোক্তা’ বলতে সাধারণ অর্থে আমরা যেকোনো পণ্যের ক্রেতা বা গ্রহিতাকে বুঝি। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এ ভোক্তাকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের যেসব কাজ ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ হিসেবে গণ্য হবে, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ সেসব কাজের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। আইনটিতে বলা হয়েছে, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্য অর্থ। ক. কোনো আইন বা বিধির অধীন নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা। খ. জ্ঞাতসারে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা। গ. মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিকারক কোনো দ্রব্য, কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে, ওই রূপ দ্রব্যমিশ্রিত কোনো পণ্য বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা। ঘ. কোনো পণ্য বা সেবা বিক্রির উদ্দেশ্যে অসত্য বা মিথ্যা বিজ্ঞাপনে ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা। ঙ. প্রদত্ত মূল্যের বিনিময়ে প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা। চ. কোনো পণ্য সরবরাহ বা বিক্রির সময় ভোক্তাকে প্রতিশ্রুত ওজন অপেক্ষা কম ওজনের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা। ছ. কোনো বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ওজন পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্র প্রকৃত ওজন অপেক্ষা অতিরিক্ত ওজন প্রদর্শনকারী হওয়া। জ. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুত পরিমাপ অপেক্ষা কম পরিমাপের পণ্য বিক্রয় বা সরবরাহ করা। ঝ. কোনো পণ্য বিক্রি বা সরবরাহের উদ্দেশ্যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দৈর্ঘ্য পরিমাপের কার্যে ব্যবহৃত পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছু প্রকৃত দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অধিক দৈর্ঘ্য প্রদর্শনকারী হওয়া। ঞ. কোনো নকল পণ্য বা ওষুধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা। ট. মেয়াদোত্তীর্ণ বা ওষুধ বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা। ঠ. সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে এমন কোনো কার্য করা, যা কোনো আইন বা বিধির অধীন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দানবীয় রূপলাভ করেছে। রমজান মাসও আগত। যুদ্ধ-বিগ্রহে মানুষের কাজ করার স্বাভাবিক গতি প্রকৃতি থমকে গেছে। কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন। গরিব, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের মানসিক ও আর্থিক টানাপড়েন, চিকিৎসা সংকট, তীব্র খাদ্যসংকট নানাবিধ সমস্যা বিরাজমান। এর মধ্যে গরিবের ত্রাণ আত্মসাৎ ও চাল চুরি কোনোভাবেই থামছে না। কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য কৃষক পাচ্ছে না। কৃষি অর্থনীতি বিপর্যস্ত। চারিদিকে হাহাকার কীভাবে উত্তরণ ঘটবে মানুষের। জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে সবাই আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। যুদ্ধের সময় তেল, গ্যাস এর দাম বেড়ে যায়, এমনিতেই দাম বৃদ্ধি আবারও যদি বাড়ে, তাহলে সেটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে। রমজানে মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে তাই ভেজাল পণ্য ও মূল্যবৃদ্ধি কার্যক্রমের সঙ্গে সুযোগসন্ধানী জড়িত ব্যক্তিদের আটক এবং মোবাইল কোর্ট অথবা উপযুক্ত আদালতে বিচারকার্য সম্পন্নের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। নিরাপদ খাদ্য ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী রমজানের সময়, বিশেষ করে বড় মজুতদাররা যাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির জন্য জরুরি পণ্য মজুত করতে না পারেন, এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মন্ত্রীদের নির্দেশ দেন। মন্ত্রীদের নিয়মিত মজুতবিরোধী অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখুন, যাতে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে থাকতে পারেন।’

সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো নবনিযুক্ত মন্ত্রীদের প্রথমে তাদের মন্ত্রণালয়ের সার্বিক বিষয়ে তথ্য জানার জন্য নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ও জনগণের জন্য কল্যাণকর যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের সময় মন্ত্রীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন। কবির ভাষায় পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। জনগণ সচেতন হলে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত আরও দৃঢ় ও মজবুত হবে। হাজার বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নাই নিশ্চিত জেনে নৈতিকতা ও নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষ হতে হবে। ব্যবসায়ীদের পণ্যের মূল্য সহনশীল রেখে রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট