পরিবেশ ও মানব স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি পানিদূষণ

মো. আরাফাত রহমান

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের কার্যকলাপের ফলে জলাশয়ে সৃষ্ট দূষণই হল পানিদূষণ। জলাশয় বলতে হ্রদ, নদী, সমুদ্র, ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তরকে বোঝায়। স্বাভাবিক পরিবেশে পানিতে দূষণকারী পদার্থ উপস্থিত থাকলে তাকে পানি দূষণ বলা হয়। অপর্যাপ্তভাবে পরিশোধিত বর্জ্যজল যদি স্বাভাবিক জলাশয়ে জমা হয়, তবে তা জলজ বাস্তুতন্ত্রের পরিবেশগত অবনতি ঘটাতে পারে। এর ফলে, ভাটির দিকে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে জনস্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তারা এই দূষিত পানি পান এবং গোসলের কাজে অথবা সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারে। পানিবাহিত রোগের প্রকোপে সারা বিশ্বে যত মানুষ আক্রান্ত হয় বা মারা যায়, তাদের বেশিরভাগই ঘটে পানি দূষণের কারণে। বহু সময় ধরে ক্রমবর্দ্ধিত কাজের ফলেই দূষণ সৃষ্টি হয়। দূষিত জলাশয়ে থাকা অথবা এর সংস্পর্শে আসা সড গাছ এবং জীবই এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দূষণের ফলে একক প্রজাতিগুলো ধ্বংস হতে পারে এবং এরা যে স্বাভাবিক জৈব সংগঠনের অন্তর্গত তারও ক্ষতি হতে পারে। পানি দূষণের কারণ হিসেবে প্রচুর রাসায়নিক এবং রোগ-জীবাণুর কথা বলা যেতে পারে; তাছাড়া অনেক ভৌত স্থিতিমাপও রয়েছে। দূষকগুলো জৈব অথবা অজৈব পদার্থের হতে পারে। উচ্চ তাপমাত্রাও দূষিত পানির কারণ হতে পারে। তাপীয় দূষণের একটি সাধারণ কারণ হল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং শিল্পোৎপাদন কেন্দ্রে কুল্যান্ট হিসেবে পানির ব্যবহার। উচ্চজলীয় তাপমাত্রা অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেয় যার ফলে মাছ মারা যায় এবং খাদ্যশৃঙ্খলের উপাদানও পরিবর্তিত হয়, প্রজাতির বাস্তুতন্ত্র কমে আসে এবং তাপের ফলে সৃষ্ট ব্যাকটেরিয়ার নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়। পানির নমুনা বিশ্লেষণ করে পানি দূষণ পরিমাপ করা হয়। ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈব পরীক্ষা করা হতে পারে। সঠিক পরিকাঠামো এবং পরিচালনা পরিকল্পনার দ্বারাই পানি দূষণকে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। পরিকাঠামোর মধ্যে থাকতে পারে বর্জ্যপানি পরিশোধক কারখানা। বর্জ্যনিকাশী পরিশোধক কারখানা এবং শিল্পজাত বর্জ্যপানির পরিশোধক কারখানা অশোধিত বর্জ্যপানির হাত থেকে জলাশয়গুলোকে রক্ষা করতে পারে। কৃষিখামারের ক্ষেত্রে কৃষিজ বর্জ্যপানি পরিশোধন এবং নির্মাণ স্থানে ভূমিক্ষয় রোধের ব্যবস্থাও পানিদূষণ প্রতিরোধ করতে পারে। পানিদূষণ রোধের আরেকটি উপায় হল প্রকৃতিকেন্দ্রিক সমাধান। স্রোতের গতি এবং এর পরিমাণ কমিয়ে শহরের নিকাশী ব্যবস্থার কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পানি দূষণের জন্য সেরা পরিচালনা ব্যবস্থা হিসেবে পানির পরিমাণ কমানো এবং পানির মান উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পানি যদি মানুষবাহিত দূষক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে সেই পানিকে দূষিত বলা হয়। এই সব দূষকের ফলে এই পানি হয় মানুষের ব্যবহারের যোগ্য হতে পারে না, যেমন পানিপানের অযোগ্য হয়ে যায় অথবা এই পানির জীবগোষ্ঠী ধারণের ক্ষমতাই নষ্ট হয়ে যায়, যেমন মাছ। আগ্নেয়গিরি, শৈবাল পুষ্প, ঝড়, ভূমিকম্প ইত্যাদি প্রাকৃতিক ঘটনার ফলেও পানির গুণাগুণে এবং এর বাস্তুতান্ত্রিক অবস্থায় প্রভূত পরিবর্তন দেখা দেয়। পানিদূষণ একটি বিশ্বব্যাপী গুরুতর সমস্যা। এর জন্য সর্বস্তরে পানিসম্পদ নীতির মূল্যায়ন এবং পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। মনে করা হয়, বিশ্বে যত রোগ ও মৃত্যু হয়, তার মুখ্য কারণ হলো পানি দূষণ। বৈশ্বিক সামুদ্রিক পরিবেশগত সমীক্ষা নামক সংস্থার মতে পানি দূষণ হলো অন্যতম প্রধান একটি পরিবেশগত সমস্যা যেটা পরবর্তী দশকগুলোতে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বকে সংকটে ফেলে দিতে পারে। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন যেগুলো ৭০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপন্ন করে এবং পৃথিবীর কার্বন ডাই-অক্সাইডের একটি বড় অংশ শোষণ করে, পানি দূষণ তাদের জন্য একটি অন্যতম সমস্যা। উন্নয়নশীল দেশে চূড়ান্ত পানি দূষণের পাশাপাশি উন্নত দেশগুলোও কিন্তু দূষণজনিত সমস্যা নিয়ে লড়াই করে চলেছে। ভূপৃষ্ঠতলীয় পানি দূষণের মধ্যে রয়েছে নদী, হ্রদ এবং সমুদ্রের দূষণ। ভূপৃষ্ঠতলীয় জল দূষণের একটি বিভাগ হল সামুদ্রিক দূষণ। সমুদ্রে দূষিত পদার্থের আগমনের একটি সাধারণ পথ হলো নদীর পানি। এর একটি উদাহরণ হলো, নর্দমার পানি এবং কারখানার বর্জ্য সরাসরি সমুদ্রে গিয়ে ফেলা। উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই বিশেষ করে এই ধরনের দূষণ দেখা যায়। প্লাস্টিক আবর্জনা সমুদ্রের বড় বড় বলয়ের মধ্যে আটকে পড়ে। প্লাস্টিক আবর্জনাগুলো সামুদ্রিক দূষণে সৃষ্ট বিষাক্ত পদার্থগুলোকে শোষণ করে নেয় যার ফলে সামুদ্রিক জীব এগুলো খেয়ে ফেললে তাদের শরীরেও বিষ প্রবেশ করতে পারে। এইসকল দীর্ঘজীবী পদার্থগুলো অনেক সময়েই শেষমেশ সামুদ্রিক পাখি এবং প্রাণীদের পেটে চলে যায। এর ফলে তাদের হজমের পথ আটকে যায়। যার ফলে তাদের খিদে কমে যায় অথবা এর থেকে তারা অনাহারেও ভুগতে পারে। মূল দূষক ছাড়াও, অনেক ধরনের অপ্রত্যক্ষ প্রভাব থাকে। যেমন ভূপৃষ্ঠে পানির স্রোতে পলি ভেসে থাকলে পানিস্তম্ভের মধ্যে দিয়ে সূর্যরশ্মি প্রবেশ করতে পারে না এবং এর ফলে জলজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। পানি দূষণকারী নির্দিষ্ট পদার্থগুলো রাসায়নিক, রোগ সংক্রামক জীবাণু এবং ভৌত পরিবর্তন যেমন উচ্চ তাপমাত্রা এবং বিবর্ণতার মতো বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। রাসায়নিক এবং অন্যান্য পদার্থ যেমন ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, লোহা, ম্যাঙ্গানিজ প্রভৃতি পদার্থ প্রকৃতিতে তাদের ঘনত্ব দ্বারা বোঝা যায়, তারা পানির স্বাভাবিক উপাদান নাকি দূষক। প্রাকৃতিক উপাদানের উচ্চ ঘনত্ব জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণীর ওপরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে দেওয়া পদার্থের মধ্যে প্রাকৃতিক বস্তু থাকতে পারে, যেমন উদ্ভিদের অংশ, আবার মনুষ্যসৃষ্ট রাসায়নিক পদার্থও থাকতে পারে। অন্যান্য প্রাকৃতিক এবং অ্যানথ্রোপোজেনিক পদার্থ পানিতে টার্বিডিটি সৃষ্টি করতে পারে যা আলো প্রবেশে বাধা দেয়, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ব্যাহত করে এবং মাছের কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে ফুলকাকে আটকে দেয়। পানির ভৌত রাসায়নিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দায়ী যেসকল বিষয় তা হল অম্লত্ব, বৈদ্যুতিক পরিবাহিতা, তাপমাত্রা এবং ইউট্রোফিকেশন। ইউট্রোফিকেশনের মাধ্যমে একটি বাস্তুতন্ত্রে রাসায়নিক উপাদানগুলোকে বাড়িয়ে দেওয়া হয়, যাতে বাস্তুতন্ত্রটির প্রাথমিক উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি হয়। ইউট্রোফিকেশনের মাত্রার ওপর পরিবেশের নেতিবাচক প্রভাব নির্ভর করে যেমন এর ফলে অ্যানোক্সিয়া হতে পারে এবং পানির মান গুরুতরভাবে হ্রাস পেতে পারে যার ফলে মাছ এবং অন্যান্য প্রাণিকূলের ক্ষতি হয়।