ভরা মৌসুমেও চালের বাজার অস্থির কেন

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো খাদ্য। এরপর বাকি সব চাহিদা। আর আমাদের প্রধান খাদ্য ভাত। যা তৈরি হয় চাল থেকে। আর চাল উৎপাদন হয় ধান থেকে। বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু দাম না কমায় মানুষের মধ্যে শান্তি ফিরছে না। উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল যদি প্রান্তিক মানুষ ভোগ না করতে পারে তাহলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বোরো উৎপাদনের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বোরো মৌসুমে ২ কোটি ৭ লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। এটি এর আগের অর্থবছরের তুলনায় তিন-শতাংশ বেশি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে মোট চাল উৎপাদন ২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়ে ৩ কোটি ৯১ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড। ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে ফসল উৎপাদন সামগ্রিকভাবে বেড়েছে। ধানি জমির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি আধুনিক জাতের ফসল ফলানোয় চাল আমদানি কমেছে। বিবিএসের তথ্যে দেখা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশের মোট ধানি জমির ৮১ শতাংশে উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ হচ্ছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা ছিল ৭৩ শতাংশ। অন্যদিকে, উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় জাতের তুলনায় বেশি ফলন দেওয়া হাইব্রিড ধানের চাষ ২০০৯-১০ অর্থবছরের ৬ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে, স্থানীয় জাতের ধান চাষ অর্ধেক কমেছে। এখন স্থানীয় জাতের ধান চাষ হচ্ছে মোট ধানি জমির প্রায় ৯ শতাংশ এলাকায়। তাছাড়া ধানের আবাদ বৃদ্ধি করতে সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। চলতি অর্থবছর বোরো মৌসুমে উচ্চফলনশীল জাতের ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে ১০৭ কোটি ৬২ লাখ টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন কৃষি মন্ত্রণালয়। এর আওতায় সারা দেশের ১৫ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক প্রণোদনা পাবেন। একজন কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় ৫ কেজি উফশী জাতের বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার বিনামূল্যে পাবেন। যার প্রভাব বাজারে থাকার কথা। কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ না থাকলেও তার দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনিতেই দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা বছর শুরুই করেন নানা চাপ নিয়ে। বাসাভাড়া বৃদ্ধি, এটার দাম বৃদ্ধি ওটার দাম বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে। বাজার থেকে শুধু চাল কিনলেই পেট ভরে না। এর সঙ্গে ভোজ্য তেল এবং অন্যান্য দ্রব্যও কিনতে হয়। এরপর চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে একজন সাধারণ আয়ের মানুষকে জীবনযাপন করতে হয়। এরপর যদি চালের দাম বৃদ্ধি পায় তাহলে দাঁড়ানোর জায়গা থাকে না। আমরা যারা ভোক্তা তাদের একটাই দৃষ্টিকোণ। তা হলো বাজার থেকে কেনা। এ দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির গতি যতটা দ্রুত হয়, মূল্য কমার গতি তার থেকে বহুগুণে কম হয়। ভোক্তারা অপেক্ষা করছে কবে ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আসবে চালের দাম। অন্তত মোটা চাল যা সাধারণত নিম্নবিত্ত আয়ের মানুষ ক্রয় করে। গ্লোবাল ফুড আউটলুক প্রতিবেদনে গত বছরই আভাস দেওয়া হয়েছিল যে, (২০২২-২৩) অর্থবছরের চেয়ে নতুন অর্থবছরে অর্থাৎ (২০২৩-২৪) উৎপাদন বাড়তে পারে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। আর মোট চালের উৎপাদনে চীন ও ভারতের পর তৃতীয় অবস্থান ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) থেকে প্রকাশ করা গ্লোবাল ফুড আউটলুক প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তথ্যমতে, চীন চাল উৎপাদনে এখনো শীর্ষে রয়েছে। গত বছর দেশটিতে উৎপাদিত হয়েছে ১৪ কোটি ২৮ লাখ টন। আগামী বছরে (২০২৩-২৪) উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ১৪ কোটি ৩৪ লাখ টন। উৎপাদন বৃদ্ধি হতে পারে দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর রয়েছে ভারত। গত বছর দেশটির উৎপাদিত হয়েছে ১৩ কোটি ৮ লাখ টন। আগামী বছরে উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ১৩ কোটি ১০ লাখ টন। উৎপাদন বৃদ্ধি হতে পারে দশমিক ১ শতাংশ। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশ। বিদায়ি বছরে দেশটির উৎপাদন ৩ কোটি ৮৩ লাখ টন। আগামী বছরে উৎপাদন দাঁড়াতে পারে ৩ কোটি ৮৯ লাখ টন। উৎপাদন বৃদ্ধি হতে পারে ১ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সময়ে ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে উৎপাদন বাড়তে পারে ১ শতাংশ। ভিয়েতনামে যা হতে পারে দশমিক ৩ শতাংশ। আয়ের সঙ্গে মানানসই ব্যয় হলে তখন অস্থিরতা কমে। ক্রমবৃদ্ধিপ্রাপ্ত এ চালের বাজারের আগুনের আঁচ লাগছে সাধারণ মানুষের ওপর। এ জ্বালা শুধু যারা নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির তাদেরই বেশি। দাম বাড়ার কারণ হিসেবে একজন অন্যের দিকে দোষারপ করছে। তবে মূল কাজটা এখনও হচ্ছে না। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ এই আশাতেই পথ চেয়ে থাকে যে চালের দাম কমবে। পাঁচজনের একটি পরিবারে যদি একজন উপার্জন ক্ষম ব্যাক্তি থাকে, তাহলে চাল কিনতেই প্রতিদিনের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে।

ক্ষুধামুক্ত দেশ গড়ার লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে চলেছি। সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলেই আজ কৃষি খাতে বাংলাদেশের এই অগ্রগতি। খাদ্য উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। খাদ্যে তো আমরা এখন স্বয়ংসম্পূর্ণই। কিন্তু খাদ্য আপামর সাধারণ জনতার কাছে সহজলভ্য করে তোলাই চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই কাজ করতে হবে। পেট ভরলেই তো সুষ্ঠু চিন্তা সম্ভব। ক্ষুধার জন্য করে না, এমন কাজ আর নেই। তাই ক্ষুধা মুক্ত দেশ গঠনের এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গরিবের ক্ষুধা নিয়ে ব্যবসার ফল যে শুভ হয় না, তা মনে হয় এসব অর্থলোভীরা জানে না। অনেক মহৎ উদ্দেশ্যই বাস্তাবায়নের অভাবে ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়। চালের মূল্য এমন একটি বিষয়, যা মূলত সব শ্রেণি পেশার মানুষের ওপরই প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে যাদের আয় সীমিত, তাদের ওপরই প্রভাব বেশি পরে। মাথায় নিত্যদিনের চিন্তা নিয়ে বের হতে হয়। ফলে মূল্যবৃদ্ধি একটি বাড়তি চাপ হিসেবে দেখা দেয়। আমরা আশা করি দাম নাগালের মধ্যেই থাকবে। দাম বৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে হবে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রাখতে হলে অবশ্যই চালের দাম হাতের নাগালে রাখতে হবে। বাজার সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে। সবার স্বার্থেই মূল্যবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সাধারণ মানুষের হাতের মঙ্গলার্থে চালের দাম হাতের নাগালেই রাখতে হবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট, পাবনা।