ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ভেজালমুক্ত খাবার আর কতদূর

এসএম মুকুল
ভেজালমুক্ত খাবার আর কতদূর

খাবারে বিষ বা ভেজালের ক্ষতি সমাজের জন্য মাদকের চেয়েও ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। কারণ মাদক যার প্রয়োজন সে সেবন করে। তবে মাদকাসক্তির কুপ্রভাব সমাজকে নানাভাবে অসহিষ্ণু করে তোলে। আর মাদকের বিষ ছড়িয়ে পড়ে সমাজে। কিন্তু খাদ্যে ভেজাল তার চেয়েও ভয়ংকর। কারণ, বেঁচে থাকার জন্য আমাদের খেতেই হবে। বাজারে কত প্রকারের খাবার ও খাদ্যসামগ্রীতে ভেজাল হয়, সে সম্পর্কে কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। দেশে ভেজাল ও নিম্নমানের খাদ্যসামগ্রীর অবাধ ব্যবহারে বছরে দ্বিগুণহারে বিভিন্ন মরণব্যাধি বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এ রকম অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ২০২০ সালের মধ্যে দেশে মরণব্যাধি মহামারি আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।

কিডনি, লিভার, শিশু, গাইনি ও ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেছেন, ভেজাল খাদ্যসামগ্রীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের পরীক্ষকদের মতে, বিষাক্ত নকল ট্যাং ও চকোলেট খেলে শিশু বা বয়স্ক যেকোনো মানুষের দ্রুত কিডনি নষ্ট, ক্যান্সার, লিভার ব্যাধি, দীর্ঘমেয়াদি পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, শিশুদের হার্টের রোগ এবং দৃষ্টিশক্তিও হ্রাস পেতে পারে। জানা গেছে, চাইনিজ রেস্টুরেন্টগুলোতে খাবারকে সুস্বাদু করতে মাত্রাতিরিক্ত টেস্টিং সল্ট ব্যবহার মানুষের শরীরের জন্য বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের ভয়ংকর ক্ষতির কারণ। এ ধরনের খাদ্য গ্রহণে গর্ভজাত শিশু বিকলাঙ্গ এমনকি গর্ভপাতও হতে পারে।

খাবার নিয়ে এখন মানুষের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, সন্দেহ, আশঙ্ক ও আতঙ্কের যেন শেষ নেই। কারণ ভেজাল খাবারে মাদকের চেয়ে ভয়ংকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে ডায়াবেটিস, ক্যান্সারসহ অসংখ্য মরণব্যাধি। এমতাবস্থায়, খাদ্যে ভেজাল আর বিষের ছড়াছড়ির আতঙ্ক নিয়ে দেশের জনগণ এখন হতবিহ্বল। এরই মধ্য দিয়ে ‘সুস্থ সবল জাতি চাই, পুষ্টিসম্মত নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই’ এই স্লোগানে গতকাল পালিত হলো জাতীয় নিরাপদখাদ্য দিবস। দিবসটি পালন উপলক্ষ্যে সারাদেশে র‌্যালি, সেমিনারসহ নানান কর্মসূচি পালিত হয়েছে। দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ‘নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার জিরো টলারেন্সে নীতি গ্রহণ করেছে। যেকোনো মূল্যে নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে চায় সরকার। তিনি আরো বলেন, ‘শুধু সরকারি কর্মকর্তারাই নয়, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতের লক্ষ্যে দেশে বর্তমানে ৪৬৩টি সংস্থা কাজ করছে।

ব্যবসায়ীরা ভেজাল খাদ্য যাতে সরবরাহ করতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সরকার কাজ শুরু করে দিয়েছে। এরই মধ্যে ঢাকার রেস্তোরাঁগুলোর মান অনুযায়ী গ্রেডিং করার কাজ শুরু হয়েছে।’

জানা গেছে, বাংলাদেশে এখন প্রায় ১২টি মন্ত্রণালয় এবং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন দপ্তর, সংস্থা, অধিদপ্তর ও স্থানীয় সরকারের প্রায় ৪৬৩টি প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এছাড়া আমাদের যেসব খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা আছে, তাদের ১২০টিরও বেশি আইন, বিধি, প্রবিধি, নীতিমালা ইত্যাদি রয়েছে। তথ্য উপাত্তে দেখা গেছে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ খাদ্য ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত। এর মধ্যে ১৫ লাখ প্রত্যক্ষ ও বাকি ১০ লাখ পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত। তবে খাদ্য নিরাপদ রাখার বিষয়ে তাদের জ্ঞানের যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

দেশের ৬৪টি জেলায় বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত ও ছয়টি মেট্রোপলিটন সিটিতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯-এর মধ্যে নিরাপদ খাদ্য আইনে তফসিলভুক্ত করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, বাংলাদেশে একটি আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর নিরাপদখাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করে রূপকল্প ২০২১-২০৪১-এর আধুনিক ও উন্নত বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ করবে সরকার। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায় নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতিবছর দিবসটি পালিত হলেও খাদ্য নিরাত্তা কতটা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে সচেতন মহলের অভিমত হলো- ভেজালবিরোধি অভিযান সারাবছর অব্যাহত রাখা এবং খাদ্যে ভেজালকারিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই।

যদিও খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধে সরকারও নিরলসভাবে কাজ করছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে বছরজুড়ে অভিযানের ধারাবাহিকতা ও নিয়মিত মনিটরিং ব্যবস্থা না থাকায় এর কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে জনগণের নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণে খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুত, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম সমন্বয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ এবং সে উপলক্ষ্যে একটি দক্ষ ও কার্যকর কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ প্রণয়ন করেছে। এই আইনটি ১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ থেকে কার্যকর হয়েছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ আমদানি পর্যায়ে অন্যান্য খাবার পরীক্ষার পাশাপাশি শিশুখাদ্য ও গুঁড়ো দুধে সীসার মাত্রা নির্ণয় পরীক্ষা চালু করার চিন্তাভাবনা করছে। খাদ্যে ভেজাল দূরীকরণ ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক সরকারি বিভাগগুলো কাজ করছে। প্রত্যেক জেলায় জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে ভেজালরোধে মোবাইল কোর্ট অভিযান চালানো হচ্ছে। আবার Bangladesh Standard and Testing Institute (BSTI) খাদ্যে ভেজাল রোধে ২ ভাগে অভিযান পরিচালনা করছে। প্রথম পর্যায়ে BSTI জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় মোবাইল কোর্ট এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে সার্ভিলেন্স টিম পরিচালনার মাধ্যমে কাজ করছে।

নিরাপদখাদ্য অভিযানের অংশ হিসেবে রেস্তোরাঁগুলোর মান অনুযায়ী গ্রেডিং প্রথা চালু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে শুধু ঢাকার ৫৭টি রেস্তোরাঁকে এ ব্যবস্থায় গ্রেডিং বা মান অনুযায়ী স্তর বিন্যাস করা হয়েছে। মান বর্ণনা অনুযায়ী, এ প্লাস মানে উত্তম, এ মানে ভালো, বি মানে গড়পড়তা বা মোটামুটি এবং সি মানে- অনিরাপদ। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ হোটেল এবং রেস্তোরাঁর মান অনুসারে স্টিকারের নাম দিয়েছে। এ প্লাসকে সবুজ, এ গ্রেডকে নীল, বি গ্রেডকে হলুদ এবং সি গ্রেডকে কমলা রংয়ের স্টিকার দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এসব হোটেলকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে বলে জানিয়েছে।

ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্যের প্রভাবে দেশে এক ধরনের নীরব হত্যার মহামারি চলছে। খাদ্যে ভেজাল মেশানোটা অনেক ব্যবসায়ীর কাছে রুটিন ওয়ার্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে- ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধির ছোবলে অকালে জীবনও হারাচ্ছে দেশের জনগণ। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য বা খাবার যেমন জরুরি, তারচেয়েও বেশি জরুরি হলো নিরাপদ খাদ্য। নিরাপদ খাদ্য কোনো দাবি নয়- সাংবিধানিক অধিকার। কারণ খাদ্য নিরাপদ না হলে সুস্থ, স্বাস্থ্যবান ও মেধাবি প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। আর তা যদি না হয়- তাহলে উন্নত বাংলাদেশের চালকরা দেশকে আরো সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কেননা, অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকিরই কারণ না, বরং দেহে নানান অসুখের কারণ।

ভয়ংকর খবরটি হচ্ছে- ভেজাল খাবার গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে সমাজের উঁচু-নিচু সব শ্রেণির মানুষ। দরিদ্র জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে অতিবিত্তবান কারোরই রক্ষা নেই ভেজালের প্রভাব থেকে। তাই এ বিষয়ে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে গণজাগরণ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণে জানা গেছে, অনিরাপদ খাদ্যের কারণে ডায়রিয়া থেকে শুরু করে ক্যান্সারের মতো দুই শতাধিক রোগের জন্য দায়ী। আরেক তথ্যে জানা গেছে, খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ৩ বছরের খাদ্যপণ্যের নমুনা পরীক্ষা করে ৫০ শতাংশ খাদ্যে ভেজাল পেয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অস্ট্রেলিয়ার ওলিংগং বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথভাবে গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের মোট খাদ্যের ৩০ শতাংশে ভেজালের উপস্থিতি রয়েছে। রাজধানী ঢাকার ৬৬ শতাংশ হোটেলের খাবার, ৯৬ শতাংশ মিষ্টি, ২৪ শতাংশ বিস্কুট, ৫৪ শতাংশ পাউরুটি, ৫৯ শতাংশ আইসক্রিম অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হয়। এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, বর্তমান সময়ে জাতির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূণ বিষয় সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা। আর এটি করতে ব্যর্থ হলে জাতির জীবনে ভবিষ্যতে অন্ধকার নেমে আসবে।

আহা, কী ভয়ংকর! এ কেমন সমাজে বাস করছি আমরা, যেখানে মানবতা ও মনুষ্যত্ববোধ চরমভাবে লাঞ্ছিত। বিবেক যেখানে অর্থের কাছে সমর্পিত। আমাদের প্রিয় সন্তান, পিতামাতাসহ আপনজনের সুস্বাস্থ্য আর সুস্থ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনায় প্রতিদিন যেন বিষের পেয়ালা তুলে দিচ্ছি তাদের মুখে, যা ভক্ষণ করে আমরা তিলে তিলে খুন হচ্ছি; খুন হচ্ছে জীবনীশক্তি। আমাদের নৈতিক স্খলন কি এতই নিচে নেমে গেছে! বিবেক বলে কি আমাদের কিছুই নেই? তাহলে আমরা নিজেদের মানুষ দাবি করব, কোন অধিকারে? লাভটাই কি আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়?

ভেজালবিরোধী অভিযান সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর খাবার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও নকল ওষুধ তৈরির কারখানায় অভিযান চালিয়ে সাধারণ খাদ্যদ্রব্য চাল, ডাল, আটা, মুড়ি থেকে শুরু করে শিশুখাদ্য গুঁড়োদুধ, পাস্তুরিত তরল দুধ, দই, আইসক্রিম, চকলেট, জুস, জেলি, কোল্ড ড্রিংকস, মিষ্টি, ঘি, হোটেলের খাবার, ফলমূল, শাকসবজি, মাছ-মাংস, মুরগি, ওষুধ, জর্দা, ওরাল স্যালাইন, ভোজ্যতেল, বেকারির খাদ্যসামগ্রী ও বিদেশি কসমেটিকসহ শতাধিক রকমের পণ্যসামগ্রীতে ভেজাল খুঁজে পাওয়া গেছে। এসব শুনে আঁতকে উঠতে হয়! আমরা কী খেয়ে আসছি এতদিন? কীভাবে বেঁচে আছি? কেন অধিক লাভের লোভে প্রজন্মের মুখে তুলে দিচ্ছি বিষের পেয়ালা? এভাবে যারা নির্বিচারে খাবারে বিষ মেশায় তারা খুনি। প্রজন্মের শত্রু! তাদের শুধু জেল-জরিমানা নয়; সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান দিয়ে দ্রুত আইন চালু করা জনগণের প্রাণের দাবি। তাদের শাস্তি হোক দৃষ্টান্তমূলক, যাতে আর কেউ খাবারে ভেজাল করে বা বিষ মিশিয়ে প্রজন্মকে মেধাশূন্য আর অসুস্থ করে তুলতে না পারে। কেননা, নিরাপদ খাদ্য দাবি নয়, অধিকার।

এসএম মুকুল

আহ্বায়ক, বইকেন্দ্রিক সামাজিকতার জাগরণে প্রচারাভিযান কর্মসূচি (বইসাজ)

বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত