ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা-অধিকার মর্যাদা এবং পশ্চিমা বিবেক

রায়হান আহমেদ তপাদার
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা-অধিকার মর্যাদা এবং পশ্চিমা বিবেক

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য কার্যত ভেঙে পড়ে। তখন যে ‘লিগ অব নেশন’ গঠিত হয়েছিল, সেই বিশ্ব সংস্থার পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে ‘ম্যান্ডেট’ দেয়া হয় প্যালেস্টাইন শাসন করার। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছিল তখন ব্রিটেন আরব এবং ইহুদি, উভয় পক্ষের কাছেই নানা রকম প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ফিলিস্তিন নিয়ে। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির কোনোটিই ব্রিটেন রক্ষা করেনি। পুরো মধ্যপ্রাচ্য তখন কার্যত ভাগ-বাটোয়োরা করে নিয়েছিল ব্রিটেন আর ফ্রান্স। এই দুই বৃহৎ শক্তি পুরো অঞ্চলকে তাদের মতো করে ভাগ করে নিজেদের প্রভাব বলয়ে ঢুকায়। ফিলিস্তিনে তখন আরব জাতীয়তাবাদী এবং ইহুদিবাদীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। ইহুদি এবং আরব মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে বসবাসকারী ইহুদিরা ব্যাপক বিদ্বেষ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সেখান থেকেই জাওনিজম বা ইহুদিবাদী আন্দোলনের শুরু। তাদের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের বাইরে কেবলমাত্র ইহুদিদের জন্য একটি রাষ্ট্র পত্তন করা। সেই সময় প্যালেস্টাইন বা ফিলিস্তিন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের অধীন। এটি মুসলিম, ইহুদি এবং খ্রিষ্টান- এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু দশকের পর দশক পশ্চিমা দেশগুলোর সম্মতি ও অনুপ্রেরণায় ইসরায়েল সরকার এবং তাদের উন্মত্ত সহযোগী বসতি স্থাপনকারীরা একটু একটু করে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। এই নির্মম স্বভাবের মিত্রের প্রতি সংহতি জানিয়ে পশ্চিমারা তাদের পর্যটনস্থলগুলো নীল-সাদা অথবা স্টার অব ডেভিডে সজ্জিত করেছে। এগিয়ে যাও, কাপুরুষ আর তাদের দোসররা। পৃথিবীকে তোমাদের প্রকৃত রং-রূপ দেখাও। আমরা তোমাদের মনে রাখব। ভুল করবেন না। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার জাতিবিদ্বেষী মন্ত্রিসভার সদস্যরা বহুদিন ধরেই চলো ফিলিস্তিনিদের প্রাণঘাতী সহিংসতার মজা দেখাই, এই পথ ছেড়ে গাজাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলেন। এই দানবীয় পরিকল্পনা নেতানিয়াহুর। তার মতো ঘৃণিত মানুষই পারেন পৃথিবীর বুক থেকে গাজাকে মুছে দিয়ে গাজা শেষ করতে। যে কেউ যে কোনো জায়গা, যে কোনো ফোরামে যদি এই কথা অস্বীকার করেন, তাহলে বলতে হবে তিনি মিথ্যাবাদী, অন্ধ অথবা দুইই। এটা ন্যায়সংগত কোনো জবাব বা প্রতিশোধ নয়, যারা কখনোই ফিলিস্তিনিরা যে অন্তহীন দুর্দশা দেখেননি বা গ্রাহ্য করেননি, আমি আবারও সেই সব সেনাসদস্যের উদ্দেশে বলতে চাই, এটা গণহত্যা। ইসরায়েলের এই ধামাধরা অনুগত লোকজন কখনো গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখা কাঁটাতারের বেড়ার ওপারে যাননি। ক্ষতি, চুরি, বঞ্চনা, অমর্যাদা, অপমান আর জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রের প্রাণঘাতী হামলা সহ্য করে যে লাখ লাখ মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে কোনোরকমে বেঁচে আছে, তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার কোনো চেষ্টাও করেননি। তারা যা করছেন তা হলো, জটিল একটি গল্পকে কালো ও সাদাদের মধ্যকার বিরোধের মতো করে অনভিজ্ঞ ও ভূগোলের জ্ঞান না থাকা মার্কিনিদের কাছে উপস্থাপন করে আসছেন। ইসরায়েলিরা সব সময় নিষ্পাপ, তারা ভুক্তভোগী। ফিলিস্তিনিরা সব সময় দোষী, ষড়যন্ত্রকারী। কাজেই জীবন বাঁচাতে যা দরকার-খাবার ও পানি অবরুদ্ধ গাজায় প্রবেশ বন্ধ করে দিন। বাসাবাড়ি ও হাসপাতালে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিন। জাতিসংঘের যে স্কুলগুলোতে দিশাহারা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো বোমা হামলা থেকে বাঁচতে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের ওপর বোমাবর্ষণ করুন। বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন শিশুদের নিয়ে অন্ধকার হাসপাতালের দিকে ছোটা অ্যাম্বুলেন্সে হামলা করুন। সাদা ফসফরাস বর্ষণ করুন, যেন ফিলিস্তিনিদের হাড় পর্যন্ত পুড়ে যায়। গুজব ছড়াতে থাকুন যে, বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি ঠেকাতে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালানো হচ্ছে। আদতে গাজাকে ২০০৫-এর ফালুজাতে রূপান্তরের চেষ্টা হচ্ছে। গাজা নামক কারাগারের ফটক শক্ত করে বন্ধ করে দিন, যেন এই দশা থেকে কেউ মুক্তি না পায়, কোনো আশা যেন না থাকে। তারপর ১০ লাখের ওপর মানুষকে গাজা ছাড়ার নির্দেশ দিন, যা পালন না করলে মৃত্যু নিশ্চিত। লম্বা এই তালিকায় যুক্ত আছেন ভালো মানুষের চেহারা নিয়ে বসে থাকা প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীরা, যারা শুধু ফিলিস্তিনিদের হামলাকে নিন্দা করেন আর ইসরায়েলিদের হামলা, ধ্বংসযজ্ঞকে স্বাগত জানান। তাই অনুগ্রহ করে কল্পনার জগতে থাকা মানুষ এবার হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (আইসিসি) ইসরায়েলসহ দুই পক্ষকে জবাবদিহির আওতায় আনার জন্য কাকুতি-মিনতি বন্ধ করুন। কারণ আইসিসি জানে, ওয়াশিংটন ডিসিতে বসে থেকে যারা এই মিথ্যার বেসাতি করছেন, তাদের মনে আঘাত দেওয়া ঠিক হবে না, উচিত নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ফিলিস্তিন শহরের রত্নটি ইসরায়েলি বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন পড়ে আছে ইট, পাথর আর সুরকি। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এ অঞ্চলের অর্ধেকের বেশি স্থাপনা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ইসরায়েলিরা আরও যা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে, তা হলো গাজা শহরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক সব স্থাপনা ও পৌর প্রতিষ্ঠানগুলো। গাজায় অন্তহীন বোমা হামলায় সব গেছে। গাজার পরিচয়বাহী সব প্রতীক, সমুদ্রতীর ও সমুদ্রতীরবর্তী অপরূপ শহর, গ্রন্থাগার, অভিলেখ্যাগার, যা কিছু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারত, তার সব। মানুষের হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছ। গাজার চিড়িয়াখানাটাও নেই। সেখানকার চিড়িয়াখানায় নেকড়ে, হায়েনা, নানা জাতের পাখি আর বিরল প্রজাতির শিয়াল ছিল। ওরা হয় ওদের হত্যা করেছে, নয়তো জন্তুগুলো না খেতে পেয়ে মারা গেছে। শহরের প্রধান গ্রন্থাগার, শিশুদের হ্যাপিনেস সেন্টার, পৌর ভবন ও অভিলেখ্যাগার, সপ্তম শতকের গ্রেট ওমরি মস্ক- সব গেছে। ইসরায়েলি বাহিনী রাস্তাঘাট, মসজিদ, গির্জা, উদ্যান কোনো কিছুই ছাড়েনি।

ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে সব। ওরা কেন জাতিসংঘের স্কুলে হামলা চালাল? গাজা থেকে ওরা মানুষের জীবনযাপনের চিহ্ন যেভাবে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তা অবর্ণনীয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত