ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের চাপে রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা

মো: হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী
দ্বাদশ জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের চাপে রাজনীতিবিদরা কোণঠাসা

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে ১৯৭ জন ব্যবসায়ীকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতে দেখে মনে হবে যেন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নয়, কোনো ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচনে অনেক সময় বিভিন্ন কারণে, বিভিন্ন চাপে, বিভিন্ন কৌশলে, অন্য পেশার লোক ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা নির্বাচিত হয়ে যান। স্বাধীনতা পূর্ব এবং স্বাধীনতা উত্তর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যেত পেশাজীবীরা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হতেন বেশি সংখ্যক। ’৯১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং পরবর্তী সময় থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেখা যায়। শুধু সংসদ সদস্য হিসেবে নয়, তারা মন্ত্রিপরিষদে স্থান করে নেন। ব্যবসায়ীরা জাতীয় সংসদ সদস্য এবং মন্ত্রিপরিষদে স্থান করে নেওয়ায় রাজনীতি জনমুখী হতে ব্যবসায়ীমুখী হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে শুরু করে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হচ্ছে ব্যবসায়ীদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে। অনেক ব্যবসায়ী তাদের অপকর্ম ঢাকতে রাজনীতিতে নেমেছেন বলে জনমহলে আলোচনা রয়েছে। শেয়ার কেলেংকারী, আদম ব্যবসায়ী, ভূমিদস্যু, ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারী, এমএলএম থেকে শুরু করে অনেক ফটকা ব্যবসায়ী তাদের পিঠ বাঁচাতে নেমেছেন রাজনীতিতে এবং তারা কালো টাকা ছড়িয়ে সফলতা পাচ্ছেন নিয়মিত। তাদের সফলতা দেখে আগ্রহী হচ্ছেন নতুন নতুন ব্যবসায়ীরা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রায় সব বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর কর্ণধাররা হয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন না হয় সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেছেন। এভাবে চলতে থাকলে একসময় জাতীয় সংসদ পরিণত হবে ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষার ক্লাবে। ২৬ জন সংসদ সদস্য নিয়ে রাজনীতিবিদরা আছেন দ্বিতীয় স্থানে। এ সংখ্যাটাও একটা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াবে একসময়। রাজনীতিকে আগে কখনো পেশা হিসেবে দেখা যায়নি। পেশাজীবীরা সাধারণত জনগণের সেবার ইচ্ছা নিয়ে রাজনীতি করতেন। স্বাধীনতার পর পর কয়েকটি সংসদে পেশাজীবীদের প্রাধান্য ছিল। পরবর্তী সময়ে রাজনীতি থেকে আয় করার সুযোগ দেখা দেওয়ায় অনেকেই অন্য পেশা ছেড়ে পুরোপুরিভাবে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করায় জনগণের চেয়ে নিজেদের আখের গোঁছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন বলে অনেকে মনে করেন। আইন প্রণেতা হিসেবে একসময় জাতীয় সংসদে আইনজীবীদের অধিক্য দেখা যেত। দেশের সাধারণ মানুষ মনে করতেন আইন প্রণেতা এবং সাধারণ মানুষের উপকারী হিসেবে আইনজীবীরা অনেকটাই এগিয়ে। দেশের জনগণ এক সময় আইনজীবী এবং ডাক্তারদের মনে করতেন তাদের ত্রাণকর্তা। সে হিসেবে তারা তাদের বেছে নিতেন সংসদ সদস্য হিসেবে। যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন এবং সাধারণ জনগণের কথা ভেবে তারা জনকল্যাণমুখী সংসদ গঠনের চেষ্টা করতেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদে তাদের সংখ্যা কমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৪ জনে যা মোটেই শুভকর মনে হচ্ছে না। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে কৃষি প্রতিনিধি মহান জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করবেন এটাই স্বাভাবিক। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ জন কৃষিজীবী সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত কৃষিজীবীদের মধ্যে প্রকৃত কৃষিজীবী নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অনেকেই বলা বলি করছেন নানান কারনে বড় বড় ব্যবসায়ীরা নিজেদের কৃষিজীবী হিসেবে পরিচয় দান করছেন। তবে সত্যিকারের কৃষিজীবীরা জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হলে দেশের অবহেলিত কৃষকদের জন্য অনেক কিছু করতে পারবেন বলে মনে করেন সাধারণ কৃষকরা। দ্বিতীয় ঈশ্বরখ্যাত চিকিৎসকরা ১২ জন সদস্য নিয়ে আছেন মহান জাতীয় সংসদে। একসময় চিকিৎসকরা অনেকটা রাজনীতিবিমুখ ছিলেন। রাজনীতিকে অপছন্দ করতেন মনে মনে। কিন্তু সম্প্রতি কয়েকটি সংসদে চিকিৎসকদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে বর্তমানে তারা রাজনীতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। সম্প্রতিকালে অন্যান্য পেশার সদস্যদের চেয়ে অনেকটা স্বচ্ছ ভাবমূর্তি নিয়ে এগিয়ে আছেন চিকিৎসকরা। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ৬ জন। তারা পেশা চাকরিজীবী হিসেবে উল্লেখ করলেও তারা প্রকৃত চাকরিজীবী বলতে যা বোঝায় তা নয়। তারা হয় কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে না হয়, নিজেই কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েও নিজেকে চাকরিজীবী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। অনেকেই একে বলছেন শুভংকরের ফাঁকি। হলফনামায় তথ্য গোপন করার জন্য অনেকে এই পন্থা অবলম্বণ করেছেন বলে অনেকের তীর্যক মন্ত্রব্য শোনা যায়। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের সময় এদেশের জাতীয় সংসদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের সদস্য হিসেবে দেখা দেয়। সামরিক শাসকদের আমলে সামরিক শাসকরা রাজনীতিবিদ বাদ দিয়ে আমলা এবং সামরিক অফিসার দিয়ে দেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা বা অপচেষ্টা চালান। উল্লেখিত দুজন প্রেসিডেন্টের শাসন আমল ছাড়াও ’৯১-এর নির্বাচিত সংসদে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অবসরপ্রাপ্ত সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জাতীয় পার্টি দল একসময় নিয়ন্ত্রিত হতো এদের মাধ্যমে। গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি ফেরত আসায় সে ধারায় কিছুটা না- অনেকটাই ব্যাঘাত ঘটেছে, যার ফলাফল লক্ষ্য করা যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলে। বর্তমান সংসদে মাত্র ছয়জন সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তা থেকে। চলতি সংসদে মাত্র ৫ জন সদস্য নিয়ে মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকদের অবস্থান। একসময় এই সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। নব্বইয়ের আগে সাধারণত কলেজ এবং হাইস্কুলের শিক্ষকরা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতেন। তারা অনেকটা নির্মোহ হয়ে জনগণের কাজ করতেন। ব্যবসায়ী এবং অর্থশালীদের দাপটে দিন দিন তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। জাতীয় সংসদ সদস্য হিসেবে তারা জনগণের কাছে সবসময় শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।

আগামীতে তাদের সংখ্যা বাড়লে জাতীয় সংসদের শ্রীবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জনগণের ভাগ্য উন্নয়নে অনেক বেশি কাজ হবে বলে মনে করেন আমজনতা। তবে এটাও সত্য বর্তমান শিক্ষকম-লীরা আগের মতো সেই জনপ্রিয়তা, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার জায়গাটাকে আগলে রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন, যার ফলে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অন্য পেশার মানুষরা অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। বুকে সাহস আর প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে মাত্র দুইজন নির্বাচিত সংসদ সদস্য নিজেদের পেশা হিসেবে উল্লেখ করেছেন মন্ত্রী-সংসদ সদস্য। মন্ত্রী-সংসদ সদস্য একটা নির্দিষ্ট পেশা হতে পারে, সেটা তাদের হলফনামা দেখে জাতি জানতে পারল। বাংলাদেশের নানান পেশার সঙ্গে নতুন আরেকটি পেশা যুক্ত হলো বলে মনে করা হচ্ছে। রাজনীতির খেলারমাঠে ক্রিকেট খেলোয়াড়রাও কম যান না। এর আগে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলেও এবার নির্বাচনে আলোচিত এবং সমালোচিত ক্রিকেটার হিসেবে মহান জাতীয় সংসদের নতুন সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বিশ্বসেরা ক্রিকেটার হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের বর্তমান অধিনায়ক। মাঠের মতো জাতীয় সংসদেও তিনি তার পারফরম্যান্স দিয়ে সবার নজর কাড়বেন বলে বিশ্বাস করেন দেশবাসী। তবে নিজেকে কতটা সামলাতে পারবেন ভিন্ন পরিবেশে সে চিন্তায় চিন্তিত আছেন অনেকে। তবে নির্বাচনে তার পারফরম্যান্সে মনে হয়েছে, তিনি রাজনীতির মাঠে লম্বা রেসের ঘোড়া হতে চলেছেন। সমাজসেবার মহানব্রত নিয়ে মানুষ রাজনীতি করে থাকেন। একসময়ের সমাজসেবক আস্তে আস্তে হয়ে উঠেন রাজনীতির পাকা খেলোয়াড়। বিগত সংসদগুলোতে অনেক সমাজসেবক নির্বাচিত হলেও বর্তমান সংসদে মাত্র একজন সমাজসেবক নির্বাচিত হতে পেরেছেন। এটা সমাজসেবকদের প্রতি দেশের জনগণের অনাস্থা নাকি জনগণের আস্থা অর্জনে তারা ব্যর্থ, সেটা নিয়ে গবেষণা করতে পারেন রাজনৈতিক গবেষক বা বিশ্লেষকরা। মহান জাতীয় সংসদে অন্য পেশার মানুষের ভিড়ে প্রকৃত সমাজসেবকরা হারিয়ে গেলে বা সংখ্যালঘু হয়ে গেলে রাজনীতির আকাশে ঘন কালো মেঘের সৃষ্টি হবে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সমাজসেবক এবং জনগণ সবাইকে ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবতে হবে। পরামর্শ দিয়ে যাদের সংসার চলে তাদের বলা হয় পরামর্শক। কেউ নিজের ঘরে বিনা পয়সায় পরামর্শ দেন কেউ পয়সা নিয়ে সব বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। পরামর্শক হিসেবে পেশা চালানো একজন দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। আগামীদিনে তিনি জাতির এবং দেশের জন্য ভালো পরামর্শ দেবেন বলে আশাব্যক্ত করেছেন দেশের সচেতন মহল। একটা সুপরামর্শ বদলে দিতে পারে একটি সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা। বর্তমান সময়ে লেখক দেখা গেলেও গবেষক পাওয়া দুস্কর। মহান জাতীয় সংসদের বর্তমান সংসদে মাত্র একজন লেখক-গবেষক নির্বাচিত হয়ে কথাটার সত্যতা প্রমাণ করেছেন। বর্তমান সময়ে লেখক-গবেষকদের অধিকাংশ কোনো না কোনো দলের লেজুড়বৃত্তি করতে পছন্দ করেন। সমাজ এবং দেশের উন্নয়নের গবেষণা না করে বিরোধীপক্ষের দোষ নিয়ে গবেষণা করেন। সবার আশা নির্বাচিত লেখক-গবেষক সমাজ, রাষ্ট্র, আইনকানুন, নিয়মনীতি নিয়ে লিখবেন এবং গবেষণা করে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার পথকে মসৃণ করে তুলবেন। এদেশে অনেকের সম্মান আছে সম্মানী নেই। আবার অনেকের সম্মানী আছে সম্মান নেই। সম্মানী ভাতা থেকে জীবন চালিয়ে রাজনীতি করা যায় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখিয়ে একজন মহান জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তার হলফ নামায় দেখা যায়, তিনি সম্মানী ভাতা থেকে প্রাপ্ত আয় দিয়ে জীবন এবং জীবিকা দুটোই নির্বাহ করে থাকেন। তাকে দেখে সবাই আশায় বুক বাঁধছেন এইভেবে যে এদেশে অন্ততে সম্মানী ভাতায় জীবন-জীবিকা এবং রাজনীতি চালানো সম্ভব। ১৮ কোটি মানুষের দেশে অনেকেই উল্লেখ করার মতো কোনো পেশায় নিয়োজিত হতে পারেন না। গ্রামের ভাষায় তাদের বলা হয় বাদ্দাম্যা। শহরের বা বইয়ের ভাষায় বলা হয় পেশাহীন মানুষ। অনেকে মনে করেন পেশাহীন মানুষ জীবনে কিছু করতে পারবেন না। মেয়ের বাপেরা তাদের সঙ্গে মেয়েদের বিয়ে পর্যন্ত দিতে চান না। কিন্তু সেইরকম একজন পেশাহীন মানুষ এইবার সংসদ নির্বাচিত হয়ে সবাইকে দেখিয়ে দিয়েছেন পেশাহীন মানুষ আর সমাজ বা রাষ্ট্রে পিছিয়ে নেই। সময় এবং সুযোগ দুটো একসঙ্গে মিলে গেলে তারও হতে পারে জনগণের ভাগ্যবিধাতা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যে যে পেশা থেকেই নির্বাচিত হোক না কেন, তারা সবাই মিলে বাংলাদেশ নামের দেশটাকে সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলবেন এবং বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করার মতো সাহসী করে গঠন করবেন, এই প্রত্যাশা করেন দেশের সব পেশা এবং পেশাহীন মানুষ।

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার (সংস্থাপন-শিক্ষক), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত