ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্মরণ

তোমার সৃষ্টি ভুলে যাওয়ার দুঃসাহস কারো নেই

রহিম ইবনে বাহাজ
তোমার সৃষ্টি ভুলে যাওয়ার দুঃসাহস কারো নেই

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে পরিচয় দেয়ার মতো কিছু নেই, একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সংগীত পরিচালক। দেশাত্মবোধক গানের সুর স্রষ্টা নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ‘সব কটা খুলে দাওনা’ ও ‘আমার আট কোটি ফুল’ গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘একতারা লাগে না দুতারা লাগে না’ অনেক গানের সুর দিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের প্রায় সকল শিল্পী তার লেখা সুর করা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। তার মধ্যে অন্যতম প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর, আমাদের চলচ্চিত্রের গানের সত্তর দশক থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত একটি চলচ্চিত্রের তিনটি ম্যাজিক থাকে। ১ গল্প, ২ অভিনয়, ৩ গান। এই তিনটা শাখাকে দর্শককে দশে দশ দেয়, সে মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রয়োজন। গল্পের সঙ্গে লোকেশন কস্টিউমস মেকআপ। একদম নিখুঁত গাঁথুনি মজবুত দৃঢ়ভাবে অভিনয় করা হলে অবশ্যই দর্শক মুগ্ধ হবে। কিন্তু গান, গান তো সিনেমার প্রাণ গল্পের সঙ্গে মিল রেখে গান রচনা জরুরি, সংগীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের প্রায় সব চলচ্চিত্র সুপার ডুপার হিট। ২০০৯ সালে মগবাজার মিডিয়া গলিতে একদিন বিকালে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলাম ওই দিন আমার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা, কুশল বিনিময়ের পরে বললাম স্যার, একদিন নিরিবিলি দেখা এবং কথা বলতে চাই- রাজি হলেন, আফতাব নগর যে বাসায় থাকতেন, ঠিকানা ফোন নম্বারসহ দিলেন, কয়েকদিন পর যোগাযোগ করে তার বাসায় গেলাম, সিনেমার জন্য একটা গল্প চিত্রনাট্য করছিলাম ‘ভালোবাসা সবার কপালে সয়না’ তিনি চিত্রনাট্য পড়ে গান রচনা করবেন, তিনি আমার কথায় রাজিও হয়ে ছিলেন। আমি মাঝেমধ্যে খোঁজ নিতাম হবে হবে বলে, অনেক বছর পার হয়ে যায়, আমি তখন বাটন ফোন ব্যবহার করি, এ সময়ের মতো দামি ফোন ছিল না, আমিও অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ২২ জানুয়ারি ২০১৯ তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। ভালো থাকবেন। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল (১ জানুয়ারি ১৯৫৬-২২ জানুয়ারি ২০১৯) বাংলাদেশের একজন সংগীত ব্যক্তিত্ব যিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সংগীত পরিচালক ছিলেন। ১৯৭০-এর দশকের শেষলগ্ন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পসহ সংগীত শিল্পে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক, শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং রাষ্ট্রপতির পুরস্কারসহ অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৫৬ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ওয়াফিজ আহমেদ ও মাতার নাম ইফাদ আরা নাজিমুন নেসা। ঢাকার আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুল থেকে তিনি মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন এবং শিক্ষাজীবনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : ইমতিয়াজ বুলবুল ছাত্রজীবনে মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত অবস্থায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের ২ নাম্বার সেক্টরে মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দারের অধীনে যুদ্ধ করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইটের পর বুলবুল ও তার বন্ধুরা মিলে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনতাই করে ছোট একটি মুক্তিযোদ্ধা দল গঠন করেন, যাদের ঘাঁটি ছিল ঢাকার জিঞ্জিরায়। জুলাইয়ে বুলবুল ও তার বন্ধু সরোয়ার মিলে নিউ মার্কেটের ১ নাম্বার প্রবেশমুখের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর লরিতে গ্রেনেড হামলা করেন। আগস্টে ভারতের আগরতলায় কিছুদিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ঢাকায় ফিরে ‘ওয়াই (ইয়াং) প্লাটুন’ নামে একটি গেরিলা দল গঠন করেন। অক্টোবরে পুনরায় ভারত যাওয়ার সময় বুলবুলসহ চারজন কুমিল্লা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাঝামাঝি তন্তুর চেকপোস্টে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে আটক হন। আটক হওয়ার পর প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে ও পরে এ অঞ্চলের শান্তি কমিটির প্রধান কার্যালয়ে নির্যাতনের শিকার হন। পরবর্তীতে বয়সে ছোট হওয়ায় তিনি মুক্তি পান; কিন্তু ঢাকায় তার নিজ বাসা থেকে পুনরায় গ্রেপ্তার হন ও জাতীয় সংসদের মানিক মিয়া এভিনিউ’র এমপি হোস্টেলে নির্যাতনের শিকার হন। সেখান থেকে তাকে রমনা থানায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয়ী হওয়ার পর মুক্তিবাহিনী রমনা থানা থেকে আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করেন। পরবর্তীতে তাকে পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

যুদ্ধাপরাধের সাক্ষী : ২০১২ সালের আগস্টে ইমতিয়াজ বুলবুল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করেন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ৯ মার্চ রাতে ঢাকার রাস্তা উড়াল সেতুর পাশ থেকে পুলিশ বুলবুলের ছোট ভাই আহমেদ মিরাজের লাশ উদ্ধার করে। তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি সরকারের কাছে তার নিরাপত্তা বৃদ্ধির আবেদন করেন এবং এটাও উল্লেখ করেন যে, সাক্ষ্য দেওয়ার পর তিনি বেশ কিছু হত্যার হুমকি পেয়েছেন।

সংগীত জীবন : আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ১৯৭৬ সাল থেকে সাল থেকে নিয়মিত গান করেন। ১৯৭৮ সালে মেঘ বিজলি বাদল ছবিতে সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৪ সালে বেলাল আহমেদের পরিচালিত নয়নের আলো চলচ্চিত্রের গীত রচনা ও সংগীত পরিচালনা করেন তিনি।

সেই চলচ্চিত্রের তার লেখা ‘আমার সারাদেহ খেয়োগো মাটি’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে’ গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়। তিনি স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন। তিনি সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, জেমস, খান আসিফুর রহমান আগুন, কনকচাঁপা, মনির খানসহ বাংলাদেশি প্রায় সব জনপ্রিয় সংগীত শিল্পীদের নিয়ে কাজ করেছেন। বুলবুল সংগীত প্রতিভা অন্বেষণে বাংলাদেশের রিয়েলিটি অনুষ্ঠান ক্লোজআপ ওয়ানের তিন মৌসুমে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত