গণঅভ্যুত্থান দিবস

গণঅভ্যুত্থান থেকে স্বাধীনতা

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে ’৬৯-এর আন্দোলন। একটি পরাধীন জাতির স্বাধীনতা তো এমনি এমনি আসে না। এর পেছনে থাকে কিছু ঘটনাবহুল ইতিহাস। যে ঘটনাগুলো পর্যায়ক্রমে ঘটে। এই ঘটনাগুলোর সঙ্গে থাকে তাজা রক্তের ইতিহাস। অর্থাৎ স্বাধীনতা একটু একটু করে ধরা দেয়। রাতারাতি স্বাধীনতা আসে না। স্বাধীনতা আসলে একটি স্বপ্ন। স্বাধীনতা অর্জনের পথে বেশ কিছু ধাপ পার হতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথেও এ রকম ধাপ পার হতে হয়েছে। প্রতিটি ধাপেই রয়েছে সংগ্রামের ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে ’৬৯-এর গণঅভ্যত্থান এক তাৎপর্যপূর্ণ মাইলফলক। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা, পরবর্তীতে ১১ দফা ও ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পথ বেয়েই রক্তাক্ত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি অর্জন করে মহান স্বাধীনতা। ১১ দফা দাবির মূলভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা। এই আন্দোলনগুলো ছিল পাকিস্তানের করা বাঙালিদের ওপর নির্মমতার প্রতিবাদ। প্রথমেই আঘাত আসে বাঙালির ভাষার ওপর। বাঙালি মেনে নেয়নি, সেদিনের পাকিস্তানের সিদ্ধান্ত। প্রতিবাদ হয়েছিল। রক্ত ঝরেছিল। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এরপর ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে। এরপর আসে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান। ১৯৬৬ সালে মুক্তিকামী নিপীড়িত জনগণের পক্ষে জাতির মুক্তি সনদ খ্যাত ৬ দফা এবং পরবর্তীতে ছাত্র সমাজের দেয়া ১১ দফা কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে সংঘটিত হয়েছিল এ গণঅভুত্থান। জানুয়ারির ২০ তারিখে আসাদের রক্ত স্বাধীনতার পতাকার রং হয়ে ওঠে। তার আগে ১৭ জানুয়ারি ছাত্রনেতারা দেশব্যাপী সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের ডাক দিলে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর মোনেম খান ছাত্র আন্দোলন দমনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। অবশেষে ২৪ জানুয়ারি গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ২৪ জানুয়ারি, ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান দিবস। পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৬৯ সালের এই দিনে সংগ্রামী জনতা শাসকগোষ্ঠীর দমন-পীড়ন ও সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে মিছিল বের করে। ঠিক যেভাবে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করেছিল ছাত্র-জনতা। মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে নিহত হন নবকুমার ইনস্টিটিউশনের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান। জনতার রুদ্ররোষ এবং গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান অভিযুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সবাইকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এটাও ছিল স্বাধীনতার চূড়ান্ত বিজয়ের আগে আরেকটি বিজয়। যা সহজ করেছিল স্বাধীনতার পথ। অত্যাচারীরা বুঝে গিয়েছিল আর বেশিদিন বাঙালির স্বাধীনতাকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। পতন ঘটে আইয়ুবের স্বৈরতন্ত্রের। ১৯৬৯-এর ৪ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা কর্মসূচি গণঅভ্যুত্থানের পথ সৃষ্টি করেছিল। শহিদ আসাদের আত্মদানের পর ২১, ২২ ও ২৩ জানুয়ারি শোক পালনের মধ্যদিয়ে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি হয়েছিল প্রতিটি পরাধীন মানুষের চোখে প্রথম স্বপ্ন থাকে একখণ্ড স্বাধীন ভূমির, একটি নিজস্ব পতাকার এবং নিজস্ব ভাষার অধিকার। পরাধীনতা একটি অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে সবাই মুক্তি পেতে চায়। পৃথিবীতে বহু জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেতে যুদ্ধ করেছে এবং আজো করছে। ব্রিটিশদের হাত থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করতে বিভিন্ন সময়ে বহু দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন। তাদের যৌবন, কিশোরবেলা ছিল স্বাধীনতার জন্য। তারপর পশ্চিম পাকিস্তানের শ্যৈনদৃষ্টি থেকে মুক্ত করে পেয়েছি স্বাধীন বাংলাদেশ। পেয়েছি লাল, সবুজ পতাকা।

একটি যুদ্ধ, একটি স্বাধীন দেশ পাওয়ার জন্য বহু মানুষের রক্ত, সম্মান, সাহস আর শক্তির সমন্বয় প্রয়োজন হয়। তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন হয় একটি স্বপ্নের। স্বাধীনতার স্বপ্ন। যে স্বপ্ন একদিন বাঙালি দেখেছিল।

সেই স্বপ্ন বাঙালির চোখে একে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৯ সালের বিবিসি বাংলায় প্রকশিত প্রতিবেদনে গণঅভ্যুত্থান ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ফলে স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্র হয়। পাকিস্তানি শাসকরা একে নস্যাৎ করতে আগরতলা মামলা করে। মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিবসহ অন্যান্যদের মুক্তি ও পাকিস্তানি সামরিক শাসন উৎখাতের দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি সান্ধ্যআইন ভঙ্গ করে সাধারণ মানুষ মিছিল বের করে। সেই মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণে প্রাণ হারান কিশোর মতিউর রহমান মল্লিকসহ চারজন। প্রতিটি প্রাণী নিজ স্বাধীনতা অর্জনে বদ্ধপরিকর থাকে। আবার একশ্রেণির প্রাণী থাকে, যারা অন্যের স্বাধীনতা হরণ করেই শান্তি পায়। একশ্রেণি শোষণকারী অপরদিকে থাকে শোষিত শ্রেণি। যারা অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে চলে। যুগ যুগ ধরে এটা হয়ে আসছে। শোষিত শ্রেণি যখনই অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে রাস্তায় নামে, সংগ্রাম করে, তখনই তাদের উপর নেমে আসে জুলুমকারীদের খড়গ। কিন্তু একথা ঠিক যে স্বাধীনতাবঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ হয় তীব্র এবং তা সব বাধা ভেঙে দেয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা। বাঙালি জাতির মরণপণ সংগ্রামের ফলেই এ স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।