ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না

জিল্লুর রহমান
সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছেই না

সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। দুর্ঘটনা রোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ গ্রহণের কথা শুনি।

কিন্তু তাতে দুর্ঘটনা কমেনি, বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধ হয়নি। এতে বোঝা যায়, দুর্ঘটনা রোধের পদক্ষেপগুলোয় অথবা সেসব কার্যকর করার ক্ষেত্রে নানা গলদ রয়ে গেছে। সেসব দূর করা খুবই জরুরি। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক উঁচু। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, শতকরা ৮০ ভাগ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বিরামহীন গাড়ি চালনা, অত্যধিক গতিতে গাড়ি চালনা এবং চালকের অসাবধানতার কারণে। একজন চালক একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পর বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় গাড়ি চালাবেন, এটিই নিয়ম। কিন্তু দেশের কোনো চালকই এ নিয়ম পালন করেন না। ফলে একজন ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত চালক যখন গাড়ি চালান, তখন স্বভাবতই দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে বেশি।

এজন্য মূলত বাস মালিকদের অত্যধিক ব্যবসায়িক মনোভাবই দায়ী। এ প্রবণতা রোধে সরকারের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

সরকারের সড়ক পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সাম্প্রতিক এক তথ্য বলছে, গত বছর ২০২৩ সালে প্রতিদিন সড়কে প্রায় ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ২০২৩ সালে সারাদেশে পাঁচ হাজার ৪৯৫টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ২৪ জন মারা গেছেন এবং ৭ হাজার ৪৯৫ জন আহত হয়েছেন। তবে সড়কে মৃত্যুর সরকারি এই হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি সংগঠনগুলোর তথ্যের পার্থক্য অনেক।

তাদের পরিসংখ্যান বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে অন্তত সাড়ে ৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ পুলিশের হিসাবে সংখ্যাটি ৪ হাজার ৪৭৫ জন, রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে ৬ হাজার ৫২৪ জন এবং বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০২৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৯০২ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৭ হাজার ৭১৩ জন। এর আগের বছর ২০২১ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ৬ হাজার ২৮৪। আর ২০২০ সালে ছিল ৫ হাজার ৪৩১ জন।

অবশ্য সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ প্রথমবারের মতো সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক তথ্য প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি পুলিশ বিভাগ, জেলা প্রশাসন এবং জাতীয় ও স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সারা দেশে থাকা ৬৪টি সার্কেল অফিসের মাধ্যমে যাচাই করে প্রকাশ করেছে। তবে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর যে হিসাব বিআরটিএ দিয়েছে, তার সঙ্গে একমত নয় পরিবহন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, সরকারি সংস্থার দেওয়া হিসাবও ভয়াবহ। ২০২৩ সালের শেষের দিকে হরতাল-অবরোধের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে দূরপাল্লার যানবাহন কম চলেছে। তারপরও দুর্ঘটনায় এত মানুষের মৃত্যু হয়েছে সড়কে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সড়ক দুর্ঘটনা একটি জাতীয় সমস্যা। শক্তিশালী রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়। শুধু কথায় বা আশ্বাসে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না, মৃত্যুও কমবে না। আসলে বাংলাদেশে সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা খুবই বিশৃঙ্খল এবং দুর্ঘটনাপ্রবণ, রাজধানী ঢাকার বাস সার্ভিসগুলোতে যা প্রকটভাবে দৃশ্যমান। শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নামে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, এর পর

গত ৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯ হাজার ৫২২ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং ২৮ হাজার ২৯৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮ হাজার ৭৯১ জন আহত হয়েছেন। হতাহতের মধ্যে শিক্ষার্থী ছিল ৩ হাজার ৯৪১ জন। এরপরও বাস্তবায়ন হয়নি নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার। যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ মতে সড়ক দুর্ঘটনার কারণগুলো- বেপরোয়া গতি, বিপদজ্জনক ওভারটেকিং, রাস্তাঘাটের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা, চালকের বেপরোয়া মনোভাব, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, লেভেলক্রসিং ও মহাসড়কে হঠাৎ ফিডার রোড থেকে যানবাহন উঠে আসা, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের করা গবেষণা অনুযায়ী, এসব সড়ক দুর্ঘটনার ৫৩ শতাংশ ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে; ৩৭ শতাংশ চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে এবং বাকি ১০ শতাংশ গাড়ির ত্রুটি ও পরিবেশের কারণে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৮ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৬টি, এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যাই ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৮৫৫টি। ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী, এ সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৮৬ হাজার ৯৫৪টি এবং এর বিপরীতে ড্রাইভিং লাইসেন্সের সংখ্যা ১৩ হাজার ৬০ হাজার ৯০৩টি। অর্থাৎ, তখন সড়কে অবৈধভাবে মোটরসাইকেলচালক ছিল ১৪ লাখ ২৬ হাজার ২৫১ জন এবং বর্তমানে এ সংখ্যা অবশ্যই বৃদ্ধি পেয়েছে। আসলে গণমাধ্যমে যে পরিমাণ তথ্য

ছাড়া, সারা রাত ডিউটি করার পর তাদের পরের দিন সকালে আবার গাড়ি চালাতে হয়। একটি লোক কীভাবে ২৪ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে পারে! ১ সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ হলেও তো অবস্থা খুব খারাপ! মুহূর্তের মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে যায়। এর জন্য ট্রিপপ্রথা দায়ী। যতদূরের যাত্রাই হোক আসা যাওয়া একজন ড্রাইভারকেই সামলাতে হয়। এরকম অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে ঘুমে ঢলে গিয়ে তিনি নিজেও একবার দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। তার মতে চালকের ডিউটি যদি সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা বা তারও কম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় তাহলে দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কমে যাবে। সড়ক নিরাপত্তা ও নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। সংগঠনটি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চালানোসহ ৯টি কারণ চিহ্নিত করেছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- যানবাহনের বেপরোয়া গতি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও পণ্যবাহী গাড়িতে যাত্রী বহন, পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধের সিদ্ধান্ত অমান্য করা, অদক্ষ চালক ও হেলপার দিয়ে যানবাহন চালানো। সংগঠনটি দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতেও ১২টি সুপারিশও করেছে। সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে- অতিরিক্ত ভাড়া-নৈরাজ্য বন্ধ করা, চালকের প্রশিক্ষণ, ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ করা, ঈদের পরে মনিটরিং কার্যক্রম বহাল রাখা, চালক-শ্রমিকদের বেতন-বোনাস ও কর্মঘণ্টা নিশ্চিত করা, জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলকে কার্যকর প্রতিষ্ঠানে হিসেবে গড়ে তোলা।

জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল দুর্ঘটনা রোধে একটি সময়োপযোগী সড়ক পরিবহন আইন করার। আইন হয়েছে। কিন্তু এর সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে না। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির নজির নেই। সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত কমিটি ১১১টি সুপারিশ করেছিল, যেগুলো পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালের জুন মাসে ছয় দফা নির্দেশনা দিয়েছিল। নির্দেশনাগুলো হলো- দূরপাল্লার গাড়িতে বিকল্প চালক রাখা, একজন চালকের ৫ ঘণ্টার বেশি গাড়ি না চালানো, চালক ও তার সহকারীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর সড়কের পাশে সার্ভিস সেন্টার বা বিশ্রামাগার তৈরি করা, অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে রাস্তা পারাপার বন্ধ করা বা সিগন্যাল মেনে পথচারী পারাপারে জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার এবং চালক ও যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধা নিশ্চিত করা। এসব নির্দেশ যাতে বাস্তবায়িত হয়, তা দেখতে তিনজন মন্ত্রীকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রধানমন্ত্রীর যৌক্তিক নির্দেশনাগুলোরও যথাযথ বাস্তবায়ন হয়নি। মনে হয় যেন গোয়ালের গরু কেতাবে আছে কিন্তু বাস্তবে নেই! সড়কের নিরাপত্তা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যু। অথচ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে বিষয়টি তেমন গুরুত্বই পাচ্ছে না, যে কারণে দুর্ঘটনা কমছে না।

ভুক্তভোগীদের দাবী, প্রধানমন্ত্রীর ছয় দফা নির্দেশনা, সড়ক পরিবহন সেক্টরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এ সংক্রান্ত কমিটির ১১১ সুপারিশের দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়ক পরিবহন আইন যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়কে নিত্যদিন কারো না কারো প্রাণ কেড়ে নেবে, মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে এবং সময় সময়ে নিরাপদ সড়ক দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সংগ্রাম চলতেই থাকবে, অথচ এর অবসান হওয়া দরকার।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কবে সবার জন্য নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের স্বপ্ন নিশ্চিত হবে। নাকি নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের বিপরীতে সড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল বাড়তেই থাকবে!

প্রকাশিত হয়, প্রকৃত দুর্ঘটনা তার চেয়ে চার বা পাঁচ গুণ বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে শুধু কমিটি গঠন এবং সুপারিশ করার চক্র থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসতে হবে। এসবের চেয়ে বেশি প্রয়োজন জনবান্ধব পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করা। এসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে একজন বাস চালক বাংলাদেশে বেশিরভাগ সড়ক দুর্ঘটনার জন্যে চালকদের অতিরিক্ত পরিশ্রমজনিত ঘুমকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছিলেন, দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ডিউটি করার কারণে ড্রাইভাররা খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। সর্বক্ষণ চালকের কাছে থাকা ইঞ্জিনের গরম হাওয়া এবং বাইরের ও আশপাশের শব্দের কারণেও চালকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েন।

লেখক : ব্যাংকার ও কলাম লেখক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত