আগ্রহ বাড়ছে চাঁদে যাওয়ার

প্রদীপ সাহা

প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশই এখন চাঁদে যেতে চাইছে। মূলত চাঁদে যাওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ১৯৫৭ সালে, যখন রাশিয়া তাদের মহাকাশ যান ‘¯পুটনিক’ উৎক্ষেপণ করেছিল। তবে ১৯৬৯ সালে মার্কিন মহাকাশ যান ‘অ্যাপোলো-১১’ এবং ১৯৭২ সালে ‘অ্যাপোলো-১৭’ চাঁদে মানুষ অবতরণ করার পর যেন প্রতিযোগিতা কিছুটা কমে এসেছিল। সবশেষে ২০২৩ সালে চাঁদ এবং মহাকাশের আরো গভীরে অভিযান শুরুর কথা জানিয়েছে রাশিয়া, ভারত এবং ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি। এরই মধ্যে নাসার ‘আর্টেমিস ওয়ান’ মিশন চাঁদের কক্ষপথ ঘুরে এসেছে। এতে এমন একটি মহাকাশ যান ব্যবহার করা হয়েছে, যা মানুষকে চন্দ্রপৃষ্ঠে নিয়ে যেতে সক্ষম। ভারতের ‘চন্দ্রযান-৩’ মিশন এরই মধ্যে সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করে এসেছে। আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ ২০২৪ সালে তাদের পরবর্তী চন্দ্র অভিযান শুরু করবে। অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘আর্টেমিস টু’।

নাসা জানিয়েছে, চাঁদে প্রথম পা রাখার ৫০ বছরের বেশি সময় পর ‘আর্টেমিস টু’ একজন নারীসহ চারজন অভিযাত্রীকে পাঠাবে। চাঁদে যেতে অভিযানটির সময় লাগবে ১০ দিনের মতো। ২০২৫ কিংবা ২০২৬ সালে নাসা ‘আর্টেমিস থ্রি’ মিশনটি পাঠাবে। চীন জানিয়েছে, তারা রাশিয়ার সঙ্গে মিলে ২০৩৫ সালের মধ্যে চাঁদে একটি যৌথ ঘাঁটি স্থাপন করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘হার্ভার্ড-স্মিথসোনিয়ান সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স’-এর জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. ম্যাকডোয়েল ২০২২ সালে বলেছিলেন- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং চীনের মতো স্পেস পাওয়ার বা মহাকাশে যেসব দেশের যাওয়ার সক্ষমতা আছে, তাদের লক্ষ্য হচ্ছে চাঁদে অভিযাত্রীদের বসবাসের জন্য একটি ঘাঁটি স্থাপন করা। মঙ্গল গ্রহের মতো স্থানে যাওয়ার আগে চাঁদ হচ্ছে প্রথম পদক্ষেপের মতো। মহাকাশের গভীরে ব্যবহার করার মতো প্রযুক্তির পরীক্ষা চালানোর জন্য চাঁদ হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। ‘ইউনিভার্সিটি অব পোর্টসমাউথ’-এর মহাকাশ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ড. লুসিন্ডা কিং বলেন- পৃথিবীর তুলনায় চাঁদ থেকে কোনো মহাকাশযান পাঠাতে কম জ্বালানির দরকার হয়। সবাই এখন জানে যে, চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পানির অস্তিত্ব রয়েছে, যাকে মঙ্গল বা মহাকাশের অন্য কোনো স্থানে যাওয়ার জন্য মহাকাশযানের জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আর চাঁদে যাওয়ার জন্য এটি হচ্ছে সঠিক সময়, যাতে সেখানে পানির কোনো একটি উৎসে মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মঙ্গলগ্রহ এবং তার বাইরে পৌঁছানোর চিন্তার পেছনে মানবসভ্যতার একটি ভিশন রয়েছে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইউরোপের পাশাপাশি চীন ও ভারতের মতো দেশ স্পেস পাওয়ার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করছে। নাসার মহাকাশযান অ্যাপোলোর অভিযাত্রীরা কয়েক দশক আগে চাঁদ থেকে যে পাথরের নমুনা এনেছিলেন, তা থেকে বিজ্ঞানীরা পৃথিবী এবং চাঁদের ভূ-তাত্ত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পেরেছিলেন। বর্তমান সময়ে অভিযাত্রীরা যে নমুনা সংগ্রহ করে আনবেন, তা থেকে আগের তুলনায় আরও বেশি কিছু জানা যাবে। কেউ যদি সৌর জগতের বিবর্তনের উৎস সম্পর্কে জানতে চায়, তাহলে চাঁদে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ভালো জায়গা নেই। কারণ চাঁদের বায়ুমণ্ডল নেই কিংবা কোনো পানির প্রবাহ নেই। চাঁদের আবহাওয়া পরিবর্তন বা ক্ষয়সাধন কিছুই হয়নি। ফলে এটি প্রাথমিক অবস্থাতেই রয়ে গেছে। সম্প্রতি (২০ জানুয়ারি ২০২৪) চাঁদে অবতরণ করেছে জাপানের নভোযান ‘মুন স্নাইপার’। চাঁদের বুকে মানুষের অবতরণের ৫০ বছর পর বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির চাঁদে নভোযান পাঠানোর চেষ্টা অব্যাহত আছে। এর মধ্য দিয়ে ৫০ দেশ হিসেবে চাঁদে সফলভাবে নভোযান পাঠাল জাপান। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন এবং খুব সম্প্রতি ভারত চাঁদে নভোযান পাঠিয়েছে। নাসা সম্ভাব্য ১৩টি অবতরণের স্থান সম্পর্কে জানিয়েছে। এগুলোর সবই চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে, যেখানে জমে থাকা পানির সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব স্থানের মাধ্যমে জমে থাকা বরফ সম্পর্কে জানা যাবে এবং সেগুলোর নমুনা সংগ্রহের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান হবে। ২০১৮ সালে বিজ্ঞানীরা মেরু এলাকায় জমে থাকা পানি বা বরফের সন্ধান পান। তারপর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরু (যেখান বরফ রয়েছে) অঞ্চলটিকেই টার্গেট করেছে। পানিকে রকেটের জ্বালানি হিসেবে অথবা চাঁদে উৎপাদনের কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন। মহাকাশ সংস্থাগুলো যদিও বরফ কীভাবে ব্যবহার করা হবে বা কী ধরনের প্রযুক্তি কতটুকু ব্যবহার করা হবে, সে বিষয়ে এখনো খুব একটা নিশ্চিত নয়। কিন্তু সবাই এখন সেখানে যেতে চাইছে, কারণ সেখানে পানির বরফ আছে। তবে এ প্রতিযোগিতার পেছনে শুধু চাঁদে বরফের আবিষ্কারের বিষয়টি জড়িত নয়, এর পেছনে রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের তুলনায় বর্তমানে চন্দ্রাভিযানের প্রযুক্তি পুরোপুরিই ভিন্ন। সেসময় শুধু যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়াই প্রথমবারের মতো চাঁদে যাওয়ার প্রযুক্তি তৈরি করেছিল। নাসার অ্যাপোলো ছিল চন্দ্রযাত্রায় রাশিয়াকে পরাজিত করার একটি পদক্ষেপ। তখন চাঁদে স্থায়ীভাবে মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করার কোনো দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে বেশ কয়েকটি দেশের চাঁদে অভিযান চালানোর মতো প্রযুক্তিগত সক্ষমতা রয়েছে।

মহাকাশে এখন আগের তুলনায় ভিড় বেড়েছে। মহাকাশে থাকা স্যাটেলাইটগুলোও পৃথিবীর অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে। এগুলো যোগাযোগব্যবস্থা বহন করে, নানা ধরনের সংকেত আদান-প্রদান করে এবং ভূ-পৃষ্ঠে থাকা কৃষিকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পানি ও অন্যান্য উৎস পর্যবেক্ষণ করে। গত ৩০ বছরে চীন তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্যতা রাখার জন্য মহাকাশ গবেষণার পরিমাণ বাড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মহাকাশ গবেষণা প্রযুক্তি সংস্থা ‘স্পেসএক্স’-এরও চাঁদে যাওয়ার মিশন রয়েছে। চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের বাসযোগ্য প্রতিবেশীদের মধ্যে একটি। এটি মঙ্গলগ্রহ ও মহাকাশ অভিযানের বিষয়ে মূল্যবান অভিজ্ঞতা সংগ্রহের সুযোগ করে দেয়। নাসা কেন আবার চাঁদে যেতে চায়- এ প্রশ্নের উত্তরে বলছে, চাঁদ বিজ্ঞানের জন্য গুপ্তধনের মতো। এটা তাদের নিজেদের পৃথিবী, সূর্য এবং আরো উন্নত সৌরজগত নিয়ে নতুন আবিষ্কারের সুযোগ করে দেয়। চাঁদের গবেষণা থেকে পাওয়া জ্ঞান নতুন প্রজন্মের চিন্তা ও কাজকে অনুপ্রাণিত করবে। এ পর্যন্ত বড় বড় সব কর্মসূচি ও অভিযানে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে এবং যে নতুন প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও সক্ষমতা বেড়েছে, তা সংস্কৃতির গঠনে কাজ করেছে নাসা। আর্টেমিস যুগে প্রবেশের এ ঘটনা বর্তমান প্রজন্ম ছাড়াও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তুলে ধরবে। আর বর্তমান আর্টেমিস প্রজন্মের কর্ম সফলতা ও অর্জনই আগামী দিনের চন্দ্রাভিযানের ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। নাসার মতে, চাঁদে যাত্রা নিয়ে এ পর্যন্ত যে হাজার হাজার কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, তা লুনার অর্থনীতি তৈরি করছে। যার আওতায় ভবিষ্যতে বিশ্ব জুড়ে আরো লাখ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। চন্দ্রাভিযান কোনো একটি দেশের উচ্চাকাঙ্ক্ষা নয়, বরং চাঁদে গবেষণার একটি যৌথ প্রচেষ্টার অংশ। তাই চন্দ্রাভিযান এখন কোনো একটি দেশের একক কোনো অভিযান নয়; এটি চাঁদ ও এর আশপাশে কমিউনিটি গঠনের প্রয়াস। এটি বিজ্ঞানীদের ধারণা দেবে- অন্য কোনো গ্রহে বেঁচে থাকতে হলে কী করতে হবে! গত ৫০ বছর ধরে শান্তিপূর্ণ গবেষণার পর নাসা চাঁদের বুকে নতুন একটি প্রজন্মকে পাঠাতে চায়, যারা দীর্ঘ সময় সেখানে থাকবে এবং চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে আর্টেমিস শিবির স্থাপন করবে। নাসার এ স্বপ্ন কি সত্যিই পূরণ হবে- এটা এখন শুধু সময়ের দাবি মাত্র।