ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

৫০০ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত

সফল বাস্তবায়ন হোক পরিবেশমন্ত্রীর ঘোষণা
৫০০ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত

রাজধানীর বায়ুদূষণ কমাতে আগামী ১০০ দিনের কর্মসূচির অধীনে ঢাকার আশপাশের ৫০০ অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘ঢাকার চারপাশে এক হাজার অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। এ ধরনের অবৈধ কর্মকাণ্ড ঘিরে দুর্নীতি হয়। অবৈধকে বৈধ করতে নানা ধরনের লেনদেন হয়। আমরা চেয়েছি এটা নির্মূল করতে। আমরা চাই না এ ধরনের ইটভাটা থাকুক। গত বুধবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মেরি মাসদুপুয়রের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকার আশপাশে যে অবৈধ ইটভাটা আছে, সেগুলো গুঁড়িয়ে দিচ্ছি। সেটা দিয়ে পুরো সমস্যা সমাধান হবে না। ঢাকা শহরে সিমেন্ট, বালু পরিবহন হয়, নির্মাণকাজ হচ্ছে, সেগুলো ঢেকে রাখার নিয়ম আছে। কিন্তু মানা হচ্ছে না। এখন যে বায়ুর মান আছে, সেটা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এখানে কিছু করতে হবে। কতগুলো ইটভাটা অবৈধ আছে, আর কতগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, জানতে চাইলে পরিবেশমন্ত্রী বলেন, ‘আদালতের হিসাবে দুই হাজারের মতো অবৈধ ইটভাটা রয়েছে। আমরা প্রথমে ঢাকার আশপাশে স্থায়ী চিমনিগুলো চিহ্নিত করছি। ১০০ দিনের কর্মসূচিতে দিনে গড়ে তিন-চারটি ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেব। ১০০ কর্মদিবসের লক্ষ্য হচ্ছে ৫০০ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেব।’

পরিবেশমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে জলবায়ু অভিযোজন চুক্তি করা হবে। চুক্তিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে মানুষের সুরক্ষা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আশা করছি, আগামী ১ মাসের মধ্যে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করব। তারপর প্রধানমন্ত্রী ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট দুজনে মিলে সই করবেন বলে আমার ধারণা।’ তিনি উল্লেখ করেন, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে সফরকালে ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে একটা জলবায়ু অভিযোজন চুক্তি করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। প্রতিবছরের মতো এবারো রাজধানীর আশপাশের ইটভাটাগুলোতে শীত মৌসুমের প্রথম থেকেই ইট পোড়ানো শুরু হয়েছে। ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে রাজধানীর বাতাসে। তাই ঢাকার বাতাস নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে খোদ হাইকোর্ট। রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী ঢাকার আশপাশের গড়ে উঠা কয়েকশ’ ইটভাটা। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) সূচক থেকে জানা যায়, বায়ুদূষণের তালিকায় বিশ্বের ১০০ শহরের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে উঠে এসেছে রাজধানী ঢাকা। এর অর্থ দাঁড়ায় এখানকার বায়ু দুর্যোগপূর্ণ বা বিপজ্জনক পর্যায়ে রয়েছে। রাজধানী ঢাকার চারপাশের অধিকাংশ ইটেরভাটা অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এগুলোর পরিবেশগত ছাড়পত্র যেমন নেই, তেমনি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তিও গ্রহণ করেনি। এসব ইটভাটা মারাত্মক বায়ুদূষণের বড় উৎস। ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া ও বর্জ্যে বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশ। এতে ভাটার আশপাশের এলাকা, নদী, শহরাঞ্চল ও গ্রামীণ জনপদের জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকির মুখে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, ইটভাটা সৃষ্ট দূষণে কৃষি জমি ও কৃষি উৎপাদন ক্ষতিরমুখে পড়ছে তেমনি, বয়স্ক ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইটভাটার কালো ধোঁয়ার কারণে মানুষের ফুসফুসের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট ও ঠান্ডাজনিত নানা রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইটভাটাগুলোতে অবাধে পোড়ানো হচ্ছে জ্বালানি কাঠ। এতে উজাড় হচ্ছে গাছপালা। অধিকাংশ ইটভাটায় পরিবেশগত ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স ছাড়াই চলছে ইট পোড়ানো কার্যক্রম।

পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, ইটভাটার কালো ধোঁয়ার সঙ্গে কার্বন, সালফার ও নাইট্রোজেন নির্গত হয়। যা বাতাসের সঙ্গে মিশে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে সালফার-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনো-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করে। রাসায়নিক ওই যৌগগুলোর কারণে ইটভাটা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষ সর্দি, কাশি, হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ নানা চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ইটভাটার কালো ধোঁয়ার সঙ্গে বিভিন্ন যৌগ বাতাসের সঙ্গে মিশে তা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। যা দেখতে কালো পাউডারের মতো। এ পাউডার মূলত নিঃশ্বাসের সঙ্গে মানুষের শরীরে ঢুকে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। এছাড়া ওই পাউডার ফসলি জমির উপর পড়লে জমির উর্বরতা কমে যায়। টিনের চালেও পড়ে আস্তে আস্তে টিন ফুটো করে দেয়। শীতের এই সময়টায় বৃষ্টি না হওয়ায় ঢাকায় বায়ুদূষণ পরিস্থিতি রীতিমতো আতঙ্কজনক পর্যায়ে রয়েছে। এখানে সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ক্ষতিকর বস্তুকণা বাতাসে বিরাজ করছে। এটা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২.৫ মাইক্রোমিটার ব্যাসের বস্তুকণার পরিমাণ ১০০ পিপিএম পার হলেই বিপজ্জনক মাত্রায় বলে ধরা হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন সূত্রে জানা গেছে, অনেক ইটভাটায় উচ্চ মাত্রার সালফার যুক্ত কয়লা ব্যবহার করা হয়। সালফারের পরিমাণ যাচাই না করে এসব ইটভাটায় কয়লা ব্যবহার করতে দেওয়ায় বায়ু দূষিত হচ্ছে। এ ছাড়া অনেক ভাটায় টায়ার ও প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। এতেও অনেক কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হচ্ছে। ইটের রং সুন্দর দেখাতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার হয়। এতে ইটভাটা এলাকার টিনের ঘরে মরিচা ধরে নষ্ট হচ্ছে। ধান, অন্যান্য সবজি ও গাছের ক্ষতি হচ্ছে। এর ফলে শ্বাসকষ্ট থেকে শুরু করে ঠান্ডাজনিত রোগ, শ্বাসনালির ক্ষতসহ নানা ধরনের মারাত্মক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে শিশু ও বয়স্কদের। ইটভাটায় বছরে ২৫ লাখ টন কয়লা ও ২২ লাখ টন জ্বালানি কাঠ পোড়ানো হয়। শীত মৌসুমে ঢাকার চারপাশে ইটভাটার দূষণে ৮৮ লাখ ৮৬ হাজার টন গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়। এর প্রভাব ঢাকার বায়ুর ওপর পড়ছে। ইটভাটা থেকে দূষণ হওয়ার কথা স্বীকার করে বাংলাদেশ ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির নেতা মো. আবু বক্কর গণমাধ্যমকে জানান, ঢাকার আশপাশে ১ হাজারের কিছু বেশি ইটভাটা রয়েছে। তিনি বলেন, ইটের ভাটাগুলোতে চিমনির সঙ্গে একধরনের পানির ঝরনা ব্যবহার করলে এই দূষণ অনেকখানি কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু সেটি ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে অনেকে এতে আগ্রহী হচ্ছেন না। দূষণের পাশাপাশি কৃষিজমিও নষ্ট হচ্ছে ইটভাটার কারণে। প্রত্যাশা থাকবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী যে ঘোষণা দিয়েছেন তার বাস্তবায়ন যেন সফল হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত