পাসপোর্ট অফিসে দালালের দৌরাত্ম্য
আন্তরিকতাপূর্ণ কাজে উজ্জ্বল হবে ভাবমূর্তি
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আমাদের সমাজে দালাল একটি অতি পরিচিত শব্দ। দালাল শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনো দুই পক্ষের মধ্যে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সহায়তা করার মাধ্যমে কমিশন গ্রহণ করা। তবে আমাদের সমাজে দালাল বলতে একটি কুচক্রী মহলকে বোঝানো হয়, যারা কোনো প্রকার সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অযথা জটিলতা সৃষ্টি করে এবং সহজ সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করে। তারা সহজ বিষয়টি জটিল করে তুলে এবং এই জটিলতা দূর করে দেয়ার প্রলোভন দেখায়। বিনিময়ে বখশিশ। মানুষ ভোগান্তি ও ঝামেলা এড়ানোর জন্য কিছু অর্থ দণ্ডি দিয়ে সেবা গ্রহণ করেন। আবার কোনো কোনো সেবা রয়েছে তা দালাল ছাড়া গ্রহণ করা বাস্তবিক অর্থে কঠিন। যেসব অফিসে কমকর্তা-কমচারী সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে আার্থিক সহায়তা গ্রহণ করতে পারেন না তারা দালালের শরণাপন্ন হয়। সেবা গ্রহীতার কাছ থেকে দালালরা যে অর্থ পায় তার একটা অংশ ওই অফিসের সংশ্লিষ্ট লোকজনকে দিয়ে থাকেন। দালাল ছাড়া ‘নিজের কাজ নিজে করি’ এই নীতিতে যারা বিশ্বাস করেন তারা সহজে সেবা পাবেন এটা ভাবা কঠিন। কেননা দালালের মাধ্যমে গেলে কাগজপত্র ঠিক! আর নিজে করতে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মধ্যে ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় সেবাপ্রাথীকে নানা অজুহাতে ফিরিয়ে দেয়া হয়। অথচ ফিরিয়ে দেয়া ব্যক্তি দালালের মাধ্যমে তার কাঙ্ক্ষিত সেবা সহজেই পেতে পারেন। দালাল হচ্ছে সেবা গ্রহীতার জন্য সহায়ক শক্তি। কেবল অর্থের বিনিময়ে আমাদের এই দেশে অনেক কিছুই সম্ভব হয়। আর সেজন্য দরকার দালাল কিংবা মধ্যস্থতাকারী। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিস ঘিরে রয়েছে এমনি এক শ্রেণির দালালদের দৌরাত্ম্য। গ্রাহকসেবার পাশাপাশি তারা গ্রাহক হয়রানির সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ে। কথা ও কাজের সঙ্গে দালাল চক্রের অনেক সময় মিল থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গত বৃহস্পতিবার গ্রাহক সেজে অভিযান চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানকালে এনফোর্সমেন্ট টিম একজন দালালকে হাতেনাতে আটক করে। একইসঙ্গে দালালদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকা ও ঘুষ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়ায় তিন আনসার সদস্যকে সাময়িক প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। দালাল চক্রের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘনিষ্ঠতাও মানুষ ভালো চোখে দেখে না। পাসপোর্ট অফিসের ভোগান্তির কথা মাঝে মাঝে উঠে আসে দেশের গণমাধ্যমে। পাসপোর্ট সংগ্রহ করার জন্য ধাপে ধাপে কাজ সারতে কয়েকবার পাসপোর্ট অফিসে যেতে হয় বলে এখানে একটি দালাল চক্র গড়ে উঠেছে। অনেকটা প্রকাশ্যে চক্রটি তাদের তৎপরতা চালায়। বড় শহরগুলোতে দালালদের দৌরাত্ম্য অনেকটা কম থাকলেও আঞ্চলিক অফিসগুলোতে তাদের প্রভাব সীমাহীন। পাসপোর্ট অফিসটিতে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্যের কারণে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে মানুষকে। অভিযোগ রয়েছে পাসপোর্ট অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা বা কর্মচারীর যোগসাজশেই এই দালাল চক্র নিজেদের অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। পাসপোর্ট অফিসে খুবই পরিচিত দৃশ্য হচ্ছে সকাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে লম্বা লাইনে সেবা নিতে দাঁড়িয়ে থাকে মানুষ। সেখানেই দ্রুত সময়ের মধ্যে কাজ সেরে দেওয়ার বিশেষ প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয় দালাল চক্র। কিছু মানুষ তাদের দ্বারস্থও হয়। এতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়ে। একজন ভুক্তভোগী তরুণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে নিজের কাজ সেরে নিতে না পারলেও দালাল চক্রের সদস্যসহ প্রভাবশালীরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজ সেরে ফেলেন। এ অনিয়মের বিষয়টি কারও পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এই অনিয়মের প্রতিবাদ করলে হেনেস্তা হতে হয় দালালচক্রের হাতে। তবে বিষয়টিকে অফিসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা অনেক সময় গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন না। বিধিতে বলা হয়েছে, কোনো সেবাপ্রত্যাশীর সঙ্গে পাসপোর্ট কার্যালয়ে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী মারধর তো দূরে থাক, দুর্ব্যবহারও করতে পারেন না। যদি এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। এই চক্রের সঙ্গে অফিসের যারা যুক্ত রয়েছেন তাদেরকে শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিরকরাও প্রতিনিয়ত পাসপোর্ট অফিসে যাতায়াত করেন। তারাও যে ভোগান্তির শিকার হন না সে বিষয়টি উপেক্ষা করা যাবে না। তারাও হয়তো ভোগান্তির শিকার হন। একজন বিদেশি নাগরিক পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে অহেতুক ঝামেলার মুখে পড়লে তিনি তার দেশের নাগরিকদের কাছে তা তুলে ধরবেন- এটাই স্বাভাবিক। পাসপোর্ট অফিসের এসব অনিয়ম যত তাড়াতাড়ি সমাধান হবে ততই স্বস্তিকর। পাসপোর্ট অফিস দাললমুক্ত হলে এবং পাসপোর্ট অফিসের কর্মীরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করলে দেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হবে।