গাজা যুদ্ধে ভুলপথে যাচ্ছেন নেতানিয়াহু

মোহাম্মদ আবুল হোসেন

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

এই দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান মেনে নিতেই হবে। যদি তা না হয়, তাহলে তাতে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান সংকট, যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি হবে। এর টেকসই সমাধানই হচ্ছে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক। সেটা না হলে পুরো অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। অবশ্য এরই মধ্যে তেমনই লক্ষণ দেখা গেছে। লেবাননে যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহর রকেট হামলা এবং তার জবাবে ইসরাইলের হামলা। হতাহত, ইয়েমেনের হুতিদের আক্রমণ, তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা আক্রমণ হয়েছে। সিরিয়ায় ইরানের সামরিক অবস্থানের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়েছে। তাতে ইরানের অভিজাত রেভ্যুলুশনারি গার্ডের পাঁচজন সিনিয়র কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। তার জবাবে ইরানও বলেছে, তারা এ বিষয়টি ছেড়ে দেবে না। তারা উপযুক্ত সময়ে, উপযুক্ত স্থানে এর বদলা নেবে। এই হামলার জন্য তারা ইসরাইলকে দায়ী করেছে, যদিও ইসরাইল এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। যদি ইসরাইলে কোনো রকম হামলা করে ইরান, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এমন হলে এই যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়বে। সেই আগুনে যে শুধু মধ্যপ্রাচ্যই জ্বলবে এমন নয়। তার তাপ পুরো বিশ্বের প্রতিটি কোণায় কোণায় পৌঁছে যাবে। কারণ, তাতে তেলের দাম বেড়ে যাবে। শুধু এই একটি পণ্যের দাম বেড়ে গেলে করোনা মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গিন বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছে গাজার যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস। বিষয়টি এতদিন পশ্চিমা মিডিয়ায় প্রকাশ্যে না এলেও আন্দাজ করা যাচ্ছিল। কারণ, হামাস বাইরে থেকে অস্ত্র পায় বলা হলেও যদি তা সত্যি ধরে নেয়া হয়, তাহলে ইসরাইলের অত্যাধুনিক অস্ত্র, ট্যাংক, আকাশপথে যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ক্ষেপণাস্ত্রের সামনে তা নস্যিমাত্র। বিষয়টি এমন যে ইসরাইল ফুঁ দিলে গাজা বা হামাস উড়ে যাবে এমন। কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর ইসরাইলি বাহিনী তাদের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। ইসরাইল আকাশপথে যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে, তা দেখে মনে হতে পারে গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তারা জয়ী হতে চলেছে। অর্থাৎ তাদের সামনে দাঁড়াতে পারছে না হামাস। যদি তা-ই হয়, তাহলে হামাসকে নির্মূল করতে এত সময় লাগছে কেন? কেন পঁচিশ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে? গাজার শতকরা ৭০ ভাগের বেশি ভবন ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে বা আংশিক ধ্বংস হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয় যে, ইসরাইলের প্রধান লক্ষ্য হলো গাজাকে তথা ফিলিস্তিনকে দখল করে নেয়া। তারপর সেখানে নিজেদের মতো বসতি স্থাপন করা। অবশ্য এরই মধ্যে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেরকমই বলেছেন। তিনি বলেছেন, গাজার পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। এমনকি জর্ডানের পশ্চিমাঞ্চল, যেখানে ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীর অবস্থিত- তাও নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার অঙ্গীকার করেছেন তিনি। ইসরাইল এবং পশ্চিমা বিশ্বের কাছে হামাস হলো একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান সিনেটর, দু’বার ডেমোক্রেট দল থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী বার্নি স্যান্ডার্স এবং ব্রিটেনের বিরোধী লেবার দলের সাবেক নেতা জেরেমি করবিন তেমনটা মনে করেন না। সম্প্রতি সাংবাদিক পিয়ার্স মরগান জেরেমি করবিনের মুখ দিয়ে হামাসকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলানোর চেষ্টা চালান। তিনি সে বিষয় এড়িয়ে গিয়ে গাজার সাধারণ মানুষের দুর্দশার কথা তুলে ধরতেই তাকে বার বার পিয়ার্স মরগান পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন- তিনি হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলবেন কি না। অর্থাৎ তার মুখ দিয়ে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন বলানোর জোর প্রচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হন পিয়ার্স মরগান। পক্ষান্তরে জেরেমি করবিন গাজায় যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ব্রিটেনের প্রতি আহ্বান জানান যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইসরাইলের ওপর চাপ দিতে। অন্যদিকে মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এবং কংগ্রেসে এই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। বার বার তিনিও গাজায় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ, অনাহারী শিশু, নারী, বৃদ্ধদের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন। যে ধ্বংসলীলা চালানো হচ্ছে গাজায় তা বন্ধ করার আহ্বান জানান। এই যুদ্ধে ইসরাইলকে সমর্থন ও অস্ত্র দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ১ ডিসেম্বর ’২৩ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে ইসরাইলকে কমপক্ষে ১৫০০০ বোমা এবং ৫৭০০০ আর্টিলারি শেল সরবরাহ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর সঙ্গে আছে ৫৪০০ হিউজ ২০০০ পাউন্ড বোমা। বার্নি স্যান্ডার্সের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের কমপক্ষে ২২০০০ বোমা ব্যবহার করেছে ইসরাইল। অন্যদিকে সিএনএন এক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, এসব বোমার অর্ধেকই ‘আনগাইডেড’ তথাকথিত ডাম্ব বোমা। এসব বোমাকে সুনির্দিষ্ট কোনো গাইড বা নির্দেশনা মতো ছোড়া যায় না। এই বোমাকে ছোড়া হলে তা বিচ্ছিন্নভাবে যেকোনো স্থানে আঘাত করতে পারে। ফলে গাজায় যে হামলাগুলো হয়েছে, তা নিশানা করে করা হয়নি। এলোপাতাড়ি ছোড়া হয়েছে। তাতে বেসামরিক জনগণের মৃতদেহের সংখ্যা শুধুই বেড়েছে এবং বাড়ছে। বার্নি স্যান্ডার্স সিএনএনকে উদ্ধৃত করে বলেছেন, গাজায় যে পরিমাণ মানুষ নিহত হয়েছেন তার মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগই নারী ও শিশু। এসব নারীর মধ্যে আছেন অনেক অন্তঃসত্ত্বা। শতকরা ৭০ ভাগ বাড়িঘর ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে অথবা আংশিক ধ্বংস হয়েছে। সেখানে ২০ লাখ মানুষ কোনোমতে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ সংকটে মানুষ মারা যাচ্ছে। তাদের কাছে ত্রাণ পর্যন্ত পৌঁছাতে বাধা দিচ্ছে ইসরাইল। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধে দেশকে ভুলপথে পরিচালিত করছেন- এ কথা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা মিডিয়াই এখন এ বিষয়টি ফলাও করে প্রচার করছে। কারণ, নেতানিয়াহুকে চ্যালেঞ্জ করে কথা বলেছেন, তারই যুদ্ধকালীন মন্ত্রিপরিষদের সদস্য গাদি আইসেনকোট। তিনি বলেছেন, গাজা যুদ্ধ নিয়ে নেতানিয়াহু মিথ্যা কথা বলেছেন। তার ওপর ইসরাইলবাসীর কোনো আস্থা নেই।