ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

গণতন্ত্রের যাত্রা পথে অর্ধশতাব্দীর অর্জন ও বিসর্জন

এ এইচ খান রতন
গণতন্ত্রের যাত্রা পথে অর্ধশতাব্দীর অর্জন ও বিসর্জন

ইতিহাস হতে গ্রহণ করা শিক্ষা মানুষকে বাস্তব জীবন ও কর্ম সম্পর্কে যতটা জ্ঞান সমৃদ্ধ করে, একাডেমিক আর কোনো শিক্ষা তার সমতুল্য নয়। পেশাগত কর্মজীবন নির্ধারণে একাডেমিক সনদ, শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি বটে; কিন্তু, তা জ্ঞানের সীমা নির্ধারণ করে না। যে কারণে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বময় কিংবদন্তি, জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ, কিংবা যুগে যুগে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সফল প্রতিভাবনরা, নিজ গুণে ও জ্ঞানে, সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন; একাডেমিক সনদে নয়। তথাপি, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে একাডেমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। রাজনীতি, সমাজনীতি, কি অর্থনীতি, সব ক্ষেত্রে ইতিহাস সব্যসাচীর মতো অগ্রসরমান। তাকে সাময়িক বিভ্রান্ত করা গেলেও, কালের গর্বে হারিয়ে যাওয়া সত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠায়, হাজার বছরের বন্ধুর পথ অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছাতে ইতিহাসই একমাত্র ভরসার স্থান। কিন্তু, ইতিহাসের মহাফেজ খানায় রক্ষিত অফুরন্ত জ্ঞান ভাণ্ডার হতে মানুষ জ্ঞান আহরণে বিমুখ; কারণ, তারা নগদে বিশ্বাসী। তথাপি, ইতিহাসের আয়নাঘরই একমাত্র অমোছনীয় দর্পণ, যেখান হতে ব্যর্থতার খাতগুলো চিহ্নিত করে, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সম্ভাব্য নকশা আঁকা যায়। যাদের উদ্দেশ্যে উপরের কথাগুলো বলা, তারা আমাদের দেশের রাজনীতির মাঠে উচ্চাভিলাসী রথী-মহারথী। একটা জাতিকে অর্ধশতাব্দী ধরে, আরব্য রজনীর আলিফ-লায়লার গল্প আর আলো তুমি আলেয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে যারা ভুল পথে পরিচালিত করছে। অথচ, কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রের সর্ঘ রাজ্যের ঠিকানা জনগণের কাছে আজও অধরা।

বাংলাদেশের প্রায় সমসাময়িককালে স্বাধীনতা লাভ করে, বিশ্ব দরবারে মজবুত গণতন্ত্র ও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিতের উপর সম্মানের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যাওয়া দেশ দুটি, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। অপরদিকে বন্দুকের নলের মুখে দেশবাসীকে বলির পাঠা বানিয়ে, ক্ষমতার দণ্ডমুণ্ডে জগদ্দল পাথর হয়ে বসে আছে পাকিস্তান ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী। তুলনামূলক দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করতে গেলে, স্বৈরতন্ত্রে সর্বনাশ ও গণতন্ত্রের ভাদ্রমাস যে, একটা জাতিকে মর্যাদার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে কোনো পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করাতে পারে, এ দেশগুলো তার উদাহরণ। আধুনিক বিশ্বায়ন যুগে প্রতিটি মানুষ কোনো না কোনো দিক হতে আজ বিশ্ব নাগরিক। সুতরাং, বিশ্ব দরবারে একজন নাগরিকের মর্যাদানির্ভর করে আন্তর্জাতিক মানদ-ের বিভিন্ন সূচকে তার নিজ দেশের সামাজিক নিরাপত্তাজনিত অবস্থানের উপর, ব্যক্তিগত আর্থিক স্বচ্ছলতার মাপকাঠিতে নয়। ’৫২ বছর আগে পাকিস্তানি সামরিক শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশ, টিনএজ পেড়িয়ে বহু আগেই পরিণত। অথচ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে, অনেক ক্ষেত্রেই আমরা; কিন্তু এবং কেনোর মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছি।

শৈশব, কৈশোর ও যৌবন পেড়িয়ে উপরোল্লিখিত চারটি দেশের অন্তত দুটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদ-ের বহু সূচকেই আমদের অবস্থান প্রশ্নবোধক। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার উদাহরণ না হয়ে আমরা, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের নেতিবাচক উদাহরণ হয়ে আছি। সোশ্যাল মিডিয়া, চায়ের আড্ডা, পত্রিকার পাতা, গোলটেবিল বৈঠক, সভা-সমাবেশ, সর্বত্র আমাদের আলোচনার উপাদান ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের বিধ্বস্ত চিত্র! সুতরাং, স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দীতে আমাদের জাতীয় অর্জন কি, এ প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিজ্ঞানীদের চন্দ্র জয়ের সফলতায়, জনগণের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস যখন বিশ্ব মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করে; আমরা তখন আলু সিন্ডিকেট ভাঙার সফলতার ছবি ছাপি। তুরস্ক ২৫ হাজার প্রকৌশলীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ঋরঃয এবহবৎধঃরড়হ ফাইটার জেট আকাশে উড়িয়ে বিশ্বকে অবাক করে দেয়; আমরা তখন রিমোট হাতে আয়েশি ভঙ্গিতে কফির পেয়ালায় চুমুক দেই আর রাজনৈতিক সহিংসতায় জনগণের করের টাকায় কেনা, রেললাইন উপড়ে ফেলে চিৎপটাং লোকো মোটিভ বিধ্বস্তের ছবি দেখি। অর্ধশতাব্দী পেরুলেও দেশের অর্জন ও বিসর্জনের হিসাব মেলাতে সাইন্টিফিক ক্যালকুলেটরও ডিজিট ফেল করে। উন্নয়ন ও দুর্নীতির সামগ্রিক তুলনামূলক খতিয়ানের গ্রাফ দাঁড়ায়; গাণিতিকহারে উন্নয়ন, জ্যামিতিক হারে দুর্নীতি, আর বাণিজ্যিক হারে পরিকল্পনাহীন প্রকল্প বাস্তবায়ন।

উন্নয়নশীল এ দেশের জনসাধারণের মাথার উপর অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা চাপিয়ে, উন্নত দেশের তালিকায় স্থান করে নেয়ার ঘোষণা যতটা না রাজনৈতিক, তার চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তা বাস্তবায়ন। কারণ, দিনশেষে দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির চাপ, আজ ভূমিষ্ঠ শিশুটির ন্যাপকিন হতে শুরু করে অশীতিপর বৃদ্ধের হাতের লাঠিসহ ১৭ কোটি মানুষের মাথার ওপর। আমাদের জাতীয় রাজস্বে আনুপাতিক হারে অতিমাত্রায় বৈদেশিক ঋণের চাপ ও বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানি মূল্য পরিশোধই মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ। এ অবস্থা হতে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়, সম্ভাব্য উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর প্রতি সর্বাত্মক মনোযোগ দেয়া। প্রশ্ন হলো, গণতান্ত্রিক অধিকার বাস্তবায়নের স্বপ্নযাত্রা লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই যাদের হাতে বিধ্বস্ত হলো; রাজনৈতিক দাবি আদায়ের নামে, অগ্নিসন্ত্রাস করে গদি দখলের স্বপ্নে বিভোর গোষ্ঠীটির রাজনৈতিক জন্মোতিহাস কি গণতান্ত্রিক? পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লৌহ জিঞ্জির ছিন্ন করে ভূমিষ্ঠ, শিশু গণতন্ত্র, ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট যাদের হাতে বিসর্জিত হলো এরাই তো তারা।

২৩ বছর সংগ্রামের ফসল সামরিক শাসনের শৃঙ্খল মুক্ত গণতন্ত্র, মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় পুনশৃঙ্খলিত হল, তাদেরই হাতে। সেদিন হেভিওয়েট বিশ্বাসঘাতক কতিপয় রাজনৈতিক নেতা জগণ্য ও বর্বর এ হত্যাকাণ্ডে নিমজ্জিত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার বা প্রতিরোধের বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে, রাজনৈতিক কৌলিন্য বিসর্জন দিয়ে, বঙ্গ ভবনে হাজির হয়ে, রাতারাতি বোল পাল্টিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক জাতির পিতা হত্যাকারীদের অবৈধ মঞ্চে। তাদের কারণেই স্বপ্ন-সাধের গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্রের অবৈধ পিঞ্জরে আবদ্ধ হয়, অনিবার্য পরিণতির সাক্ষী হয়ে।

সেই থেকে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গঠনমূলক বিরোধিতা করার মতো একটা শক্তিশালীবিরোধী দল গড়ে উঠেনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে। এর দায় সম্পূর্ণরূপে ক্ষমতালোভী রাজনৈতিকদের। মোনাফেক মোস্তাক অধিষ্ঠি হয় রাষ্ট্রপতির পুতুল মঞ্চে। কিন্তু, চিত্র নাট্যের কয়েকটি মাত্র দৃশ্য মঞ্চস্থের পরই ধীরে ধীরে পর্দার অন্তরালের কালো চশমাধারী নৈপথ্য নায়ক জিয়াউর রহমানের আত্মপ্রকাশ প্রত্যক্ষ করল জাতি।

নানান নাটকীয়তার পর, রক্তে লেখা সংবিধানের বুকে বন্দুকের নলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শুরু হলো স্বৈরতন্ত্রের বাইপাস সার্জারি। প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত সংবিধান ছিন্ন ভিন্ন হয়ে স্বৈরাচারের শেকলে বাধা পড়ল বাংলাদেশ। অপকর্মের এখানেই শেষ নয়, ক্ষমতা নির্বিঘ্ন করতে চলল নির্বিচার গ্রেপ্তার আর ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধা গণহত্যার মহোৎসব। ইতিহাসের তিমিরাচ্ছান্ন এ পর্বটির মাসুল আজো দিয়ে যাচ্ছে জাতি। যার জন্য দায়ী বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত ও বিশ্বাস ঘাতক কতিপয় অনুসারী। চরিত্রহীন রাজনীতিবিদরা, সেদিন এ ঘটনার সহযোগী না হয়ে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পরলে, ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। জিয়ার তমশাচ্ছান্ন অধ্যায় সমাপ্তি হতে না হতে আরেক স্বৈরাচার এরশাদ একই কায়দায় জাতির জীবন থেকে কেড়ে নেয় ৯টি বছর। দেশ কেন পিছিয়ে, এ প্রশ্নের উত্তর, বিসর্জিত ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে প্রত্যাখাত স্বৈরশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সহযোগী রাজনীতিবিদের। যারা ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর নারকীয় হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত এবং কোনো না কোনো উপায়ে হত্যা পরবর্তী সময়ের বেনিফিসিয়ারি। যাদের অনেককেই আজও পর্যন্ত বিচারের মুখোমুখি পর্যন্ত হতে হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে এ জাতীয় হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড, সরাসরি হত্যায় জড়িত এবং হত্যাকাণ্ডের বেনিফিশিয়ারি কেউ, বিচারের মুখোমুখি না হয়ে রাজনীতির সুযোগ লাভ করেছে বলে জানা নেই। যেটি এদেশের মাটিতে আজও চলমান। অর্জিত স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধকে কটাক্ষ করে রাজধানীর বুকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে তারা দেশবিরোধী বক্তব্য দেয়। তাদের ছত্রছায়ায় পর্যায়ক্রমে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন গড়ে উঠেছে প্রতিটি সেক্টরে। মানুষ নৈতিকতা হারিয়ে পেশাগত আয়কে গৌণ ভেবে অবৈধ উপার্জনে গাড়ি বাড়ি করাকে অধিকার মনে করছে। জনসেবার রাজনীতি হয়ে উঠে গাড়িবাড়ি আর স্বপ্ন পূরণের আলাউদ্দিনের চেরাগ। স্বাধীনতাবিরোধীদের শক্ত হাতে বিচার না করে রাজনীতির সুযোগ দেয়ায়, দেশি-বিদেশি চক্রান্তের সমন্বয়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সরকারকে উন্নয়ন চিন্তার পাশাপাশি ষড়যন্ত্র সামাল দেয়ার পেছনেও সময় দিতে হচ্ছে; এটা অর্থবহ স্বাধীনতার পথে বিশাল অন্তরায়। একটা দেশে একাধিক রাজনৈতিক দলের দলীয় আদর্শগত মতবিরোধ থাকতে পারে; এটাই গণতন্ত্র। কিন্তু, একই সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী স্বাধীনতার পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি মুক্তিযুদ্ধের অর্জন ও বিসর্জনের প্রশ্নটি স্বাভাবিকভাবেই সামনে এসে দাঁড়ায়। কারণ, হত্যাকারী এবং হত্যাযজ্ঞের শিকার, দুপক্ষ কখনই একসঙ্গে পথ চলতে পারে না, এটি জাতির অস্তিত্বর প্রশ্নে সাংঘর্ষিক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত