ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতটা সামাজিক?

ইঞ্জিনিয়ার ফকর উদ্দিন মানিক
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কতটা সামাজিক?

আধুনিক জীবনের নতুন এক অনুষঙ্গ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে ফেসবুক। প্রযুক্তিবিদের মতে বর্তমানে পৃথিবীর ইতিহাসে আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় আসক্তির নাম ফেসবুক। যদি এর সঙ্গে আজকাল প্রায় সব বয়সিরই অন্যরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আর এই যোগাযোগমাধ্যমগুলোর উপর নির্ভরশীল মানুষগুলো একে ভার্চুয়াল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই রয়েছে।

তাই সবার আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ব্যবহারকারীরা নিজেরা কতটা সামাজিক? প্রযুক্তি দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিচ্ছে আবেগ। হয়তো এই জন্যই আমাদের আবেগ অনুভূতি খুব সহজেই ফেসবুকের পাতায় অবস্থান করার ফলেই ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি, গোপনীয়তা ও স্বাধীনতা বলে আর কিছু থাকছে না। ফলে ফেসবুকে ব্যক্তির পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করলে বিভিন্ন ব্যক্তির আচরণ এবং পারিবারিক শিক্ষার একটা চিত্র দৃশ্যমান হয়।

সেখানে রীতিমতো হুমকিস্বরূপ নানান পোস্টের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে কিছু নান্দনিক বোধও দেখা যায়। কিন্তু দ্বিধাহীন চিত্তে আমরা উন্মুক্ত ফেসবুকীয় প্ল্যাটফর্মে নিজের ভেতরকার সহিংস মানুষটাকে প্রতিনিয়ত প্রকাশ করে ফেলছি, যেখানে কোনো অনুশোচনা নেই। এমনকি নেতিবাচক স্ট্যাটাসকে নিয়ন্ত্রণ না করে এমন সব পাল্টা নোংরা মন্তব্য করি, তাতে মানুষের আচরণের স্বরূপতা দেখে শঙ্কিত হতে বাধ্য। তাই এখন একটাই আওয়াজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারণে নাটকীয়ভাবে যোগাযোগের পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে।

শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, আমরা নিজেরাও বইয়ের প্রতি আর তেমন আগ্রহ অনুভব করি না। কারণ মনোযোগের একটা বড় অংশই চলে যায় ডিজিটাল ডিভাইসের স্ক্রিনের পেছনে। সেই জন্যই কি বুকার পুরস্কার বিজয়ী ব্রিটিশ লেখক হাওয়ার্ড জ্যাকবসন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হবে? অতীতের সাত সমুদ্র তের নদীর ওপার এখন ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে হাতের মুঠোয়। এখন খুব সহজেই অনলাইনে গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করা যায়, যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ মহামারী করোনার সময় রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিটিংগুলো ভার্চুয়ালি সম্পন। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের কাছে পৃথিবীর মানচিত্রে দেশ-বিদেশের বিন্দুগুলো ফোনের পর্দায় একটি বৃত্তমাত্র। আর এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণ সর্বত্র ছড়িয়ে যাওয়ার কারণেই কি মার্শাল ম্যাকলুহান সমগ্র বিশ্বকে একটি গ্রামের সঙ্গে তুলনা করেছেন? এখনো দেশের বেশির ভাগ মানুষ চিলে কান নেওয়ার মতো গুজবে বিশ্বাসী। হুট করেই আবেগপ্রবণ, কোনো কিছু বুঝার আগেই চরম উগ্র। যে উগ্রতা কখনো কখনো সামাজ, সংসার তথা রাষ্ট্রের জন্যও চরম হুমকি হয়ে দেখা দেয়। ভার্চুয়াল অগ্রগতির সহজলভ্যতায় যেনতেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের কারণে ইদানীং মানুষ সাধারণ বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা করার মতো মানসিকতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলার কারণে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা।

কমছে একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্য, সৌজন্যতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষগুলো অল্পতেই হয়ে ওঠেন পরম আপন। আর চিরচেনা মানুষ কখনো কখনো শুধু লাইক-কমেন্টের কারণে হয়ে যান চরম শত্রু। তবে ফেসবুকের কল্যাণে মানুষগুলোর ভেতরের রূপটা খুব ভালোভাবে বোঝা যায় বলে ফেসবুকের অপর নাম বলা যেতে পারে মনের আয়না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে মানুষ মানবীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক দূরত্বকে জয় করে নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। এমনকি, ব্যক্তিগত যোগাযোগের পাশাপাশি সমসাময়িক রাজনীতি, অর্থনীতি, সাহিত্য ও সামাজিক বিষয়গুলো এখন ফেসবুক স্ট্যাটাসেই স্থান করে নিচ্ছে। এসব স্ট্যাটাস নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। তথাপি, সামাজিক যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মগুলোর বহুবিদ নেতিবাচক দিক ছাড়াও অনেক ইতিবাচক দিকও রয়েছে।

এসব মাধ্যমের পরিমিত ব্যবহার শিশুদের সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করে ভার্চুয়াল নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে। ফেসবুকের কল্যাণে অনেক গঠনমূলক সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়ে থাকে। ছোট্ট একটি পোস্টের কারণে আইসিইউতে মুমূর্ষু অবস্থায় থাকা হাজারো মানুষ রক্ত পেয়ে বেঁচে যায়। ফলে উপকৃত হয় অনেক দুস্থ ও অসহায় পরিবার। তাই যুগের এই পরিবর্তনের জন্য প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের শত্রুতা না করে প্রযুক্তিকে ইতিবাচক কাজে ব্যবহার করতে হবে। ফেসবুক পোস্টে কে কে লাইক কমেন্ট দিল, তা নিয়ে ভাবার চেয়ে বরং পোস্ট সামাজিকভাবে কতটা গুরুত্ব বহন করে তা নিয়ে ভাবা উচিত। ব্যক্তির নেতিবাচক মন্তব্য শুধু তার ব্যক্তিত্বের পরিচয়ই বহন করে না বরং ফেসবুকের মাধ্যমে সেই নেতিবাচকতা অগণিত পরিবারের সদস্যদের মননে খুব দ্রুত ছড়ায়। ফেসবুকে মন যা চাইবে তা লেখা কখনোই স্বাধীনতা নয় বরং তা স্বেচ্ছাচারিতা। আমাদের মনে রাখা উচিত- আমার যেমন যেকোনো কিছু পোস্ট করার স্বাধীনতা আছে, তেমনি অন্য আরেকজনেরও শালীনতাও বজায় রাখার অধিকার আছে।

উদ্বেগের বিষয় হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের কিশোর তরুণরদের বিপদগামী করে বিভিন্ন অপরাধী চক্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন অসামাজিক কাজ করাচ্ছে। তাই, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তরুণদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়া ঠেকাতে অভিভাবকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সন্তানদের আচার-আচরণে অসঙ্গতি এসেছে কি না, সে বিষয়ে নিয়মিত খেয়াল রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, অভিভাবকরা সন্তানদের যথেষ্ট সময় দিয়ে তাদের সঙ্গে আস্থা, বিশ্বাস ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করতে পারলে তারা বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আশ্রয় খোঁজবে না। সংস্কৃতি হচ্ছে জীবনের দর্পণ। জাতি হিসেবে আমরা কতটা উন্নত ও আধুনিক তা আমাদের সংস্কৃতির বিকাশ ও ঐতিহ্যও দেখলেই বোঝা যায়। সাঁজ সকালে আগে প্রতিটি পরিবারেই সংগীতসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের চর্চা হত। কিন্তু নগরসভ্যতার ক্রমবিকাশ ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার ও আকাশ সংস্কৃতির কারণে আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভিনদেশি সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ ঘটছে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ভিনদেশী সংস্কৃতির যতটুকু সামঞ্জস্য, ঠিক ততটুকুই গ্রহণ করতে হবে। অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বিকাশ ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তৃণমূল পর্যায়েই বেশি গুরুত্ব নিতে হবে। দেশের যুবসমাজকে আধুনিক, দক্ষ, সংস্কৃতিমনস্ক, সুস্থ ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন জনশক্তিতে পরিণত করতে হলে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটাতে হবে। তবে এটাও ভাবতে হবে সংস্কৃতিতে প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার সংস্কৃতিকে আরো বেশি সমৃদ্ধ করবে। সমাজে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রচুর আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক অব্যাহত থাকবে। ব্যবহারকারীর ব্যবহার অনুযায়ী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হতে পারে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক। পারস্পরিক যোগাযোগ, সচেতনতা, জনমত তৈরি, সমাজসেবা, সৃজনশীলতা ও ব্যবসায়িক কাজের মাধ্যম হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহৃত হলেও নানা নেতিবাচক ও অপরাধমূলক কাজেও এর ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যাতে অনাকাঙ্ক্ষিত কাজে ব্যবহৃত হতে না পারে, তার জন্য আমি, আপনি ও আমাদের সবাইকেই সচেতন হতে হবে। ইতিবাচক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রযুক্তি অভিশাপ না হয়ে আশীর্বাদ হবে- এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সামাজিক কাজে ব্যবহৃত হয়ে সামাজিক গুণ সম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি করে ইতিবাচক সমাজ বিনির্মাণে প্রমাণ করুক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসলেই সামাজিক।

লেখক : সভাপতি- কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ এলামনাই এসোসিয়েশন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত