অভিমত

আত্মহত্যাই কি সব সমাধান? প্রয়োজন কথা বন্ধুর

শারমিন সুলতানা রিমি

প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ইদানীং খুব কমন একটা বিষয় হল আত্মহত্যা। প্রায় প্রতিদিনই টিভি চ্যানেল খুললে বা ফেসবুকে ঢুকলেই দেখা যায়, কেউ না কেউ আত্মহত্যা করেছে! আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সেখানে বয়স্কদের তুলনায় তরুণদের সংখ্যাই বেশি! আশ্চর্য কেন বলেছি তা বলছি। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই যত বড় বা বয়স্ক হবে, তত তার অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পাবে। তবে দেখা যায়, মানুষকে তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বেশি হতে হয়। সেই তিক্ততা একটা সময় বিষাদে পরিণত হয়... যা মানুষটাকে জিন্দা লাশ বানিয়ে রাখে। তাই তিক্ততা বা বিষাদের পরিমাণ পরিমাপ করলে, একজন বয়স্ক ব্যক্তির আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ার কথা। কারণ আশাহত একটা মানুষের জীবনে আর কোনো চাওয়া পাওয়া থাকে না। কিন্তু তরুণরা আত্মহত্যার দিকে বেশি ঝুঁকছে, কেন? এই কেন এর উত্তর দিতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়... মাত্র কয়েকটা কারণ বলছি, বয়ঃসন্ধিকাল, অতিরিক্ত আবেগ, অতিরিক্ত প্রত্যাশা, সবাইকে চোখবুঝে বিশ্বাস করার প্রবণতা, ফ্যামিলি প্রবলেম, একাকিত্ব, সেল্ফ রেসপেক্টের অভাব, সাপোর্টের অভাব, বাবা বা মায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক না থাকা, ডিপ্রেশন, ধর্মীয় অনুশাসনের উপস্থিতি না থাকা। আমার কথাই বলি, আমি একজন প্রাপ্তবয়স্কা। কিন্তু আমার মাঝেও যে এটা কখনো দেখা দেয়নি তা না। হয়তো বা একেক সময়ের ব্যাখ্যা একেক রকম ছিল মাঝেমধ্যেই মনে হয়েছে, গলায় ফাঁস লাগাই, আবার মাঝেমধ্যেই মনে হয়েছে হাতের উপর ব্লেড রেখে জাস্ট একটা টান দিয়ে দেই, কখনো কখনো মনে হয়েছে বিষ খেয়ে মৃত্যু অনেক শান্তির, আবার কখনো কখনো মনে হয়েছে ১০ তলা ভবনের উপর থেকে লাফ দিয়ে পরলে হাড় ভাঙার যে শব্দটা হবে বা মাথার খুলি যে চটাস করে ফেটে যাবে, সেটাও একটা চমৎকার ব্যাপার হবে... এখন ভাবতে পারেন, এগুলো মনে হওয়ার কারণ কি? কারণ যে আসলে কি, সেটা আমরা সঠিক করে কেউই জানি না! একটা সময় মনে হয়েছে, সব মানুষের ভিড়েও আমি একা, আমার সঙ্গে কথা বলা বা কথা শোনার মতো কেউ নেই। চরম একাকিত্ব যাকে বলে!

আমি খুব চঞ্চল স্বভাবের, প্রচুর হাসিখুশি। কিন্তু জানেন তো, হাসিখুশি মানুষগুলো নিজের সমস্যার কথা অন্যকে জানাতে পারে না কিংবা বোঝাতে পারে না। আর আত্মহত্যা করা ছেলে বা মেয়েটির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে দেখেন, তার বাবা-মা সেম কথাটি বলবে, আমার মেয়ে-ছেলে তো খুব হাসিখুশি স্বভাবের ছিল, সে কীভাবে এটা করল! হাজারো মানুষের ভিড়ে নিজেকে একা বলে আবিষ্কার করেছি। নিজের ভালো লাগা, মন্দলাগা অন্যকে জানাতে চেয়েছি, কিন্তু মনে হয়েছে, শোনার মতো আসলে কেউই নেই। একটা ব্যাপার কি জানেন, ১০০ শতাংশ পরিবারের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ পরিবার সন্তান কে বুঝতে পারে বা বোঝার চেষ্টা করে। বাকি ৯৫ শতাংশই বুঝে না তাদের কি করা উচিত। একটা মানুষ যখন আত্মহত্যা করে, তখন প্রচুর জ্ঞানী লোকের উদয় হয়। তখন তারা গম্ভীর গলায় বলে উঠবে, আত্মহত্যা মহাপাপ, এটা কোন সমাধান নয়। কিন্তু আপনি তার কাছে সমাধান জিগ্যেস করে দেখুন, আমি বাজি ধরতে রাজি, সে আপনাকে সঠিকভাবে বলতে পারবে না, যে সমাধান টা কি? কারণ এর সমাধানের ব্যাপারে আমরা অনেক বেশি উদাসীন। আমরা মানুষকে জ্ঞান দিতে পছন্দ করি, কিন্তু নিতে নয়। আমরা তিরস্কার করতে জানি, প্রশংসা নয়! আমরা উপহাস করে মজা নিতে জানি, কিন্তু পাশে দাঁড়ানোর কথা বলতে পারি না। আমরা কথা বলতে পছন্দ করি; কিন্তু কারও কথা শোনার ধৈর্য ধরতে পারি না। আমরা শাসন করতে বুঝি, ভালোবেসে সমাধানের ব্যাপারটা বুঝি না। আমরা বাঙালি, সামান্য কারণে ছেলেমেয়ে, স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে জানি, কিন্তু ভরসার হাত বাড়িয়ে দিতে জানি না... এগুলোই হলো মানুষের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা। এই যে অল্পবয়সি ছেলেমেয়েগুলো চরম ডিপ্রেশনে ভোগে-এর কারণ কি? প্রতিটা প্রবলেমই শুরু হয় পরিবার থেকে। সেটা প্রেম বলেন, পরকীয়া বলেন, বা নির্যাতনের কথা বলেন! আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পাবেন, আত্মহত্যা করা বেশিরভাগ ছেলেমেয়েরই ফ্যামিলি প্রবলেম। হয়তো বাবা-মার ডিভোর্স, নয়তো অতিরিক্ত শাসন, অতিরিক্ত স্বাধীনতা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অভাব, ভার্চুয়াল জগতে অগাধ বিচরণ, বাবা-মা দুজনই চাকরিজীবী। প্রতিটা ফ্যামিলি যদি তার সন্তানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে, তাদের সময় দেয়, তাহলে আমার মনে হয় আত্মহত্যার মতো ঘটনা কমে যাবে... কারণ আপনার সন্তানটি যদি চরম হতাশায় নিমজ্জিত থাকে, সেটা আপনার জানতে হলে আগে আপনাকে তার কাছাকাছি যেতে হবে। যেটা শাসন করে সম্ভব নয়। সে তার সহপাঠী দ্বারা প্রতারিত হয়েছে, তার প্রেমিক বা প্রেমিকা তাকে ধোকা দিয়েছে, পরীক্ষার রেজাল্ট নিয়ে সে লজ্জিত, সে নিজের বাসায় বা বাসার বাইরে হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছে, প্রচণ্ড একা লাগছে, অসহায়ত্বে ভুগছে, তারা বলার চেষ্টা করেছে; কিন্তু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অভাবে কিছুই বলতে পারেনি। আপনারা তাদের সঙ্গে কথা বলুন, জানার চেষ্টা করুন, অভয় দিন, সাহস দিন, হাসুন, প্রচুর হাসুন, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যান, সময় দিন... এই সাপোর্টগুলো তার মনে শান্তি এনে দিবে, সে হতাশায় নিমজ্জিত হবে না। মানুষ যখন বয়ঃসন্ধিতে থাকে, তখন তার আবেগ হয় আকাশছোঁয়া, হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায় তখন। ভালো মন্দের হিসেব তারা করতে জানে না। অল্পতেই অভিমানী হয়, আবার অল্পতেই ভেঙে পরে। তাই সাপোর্ট দিন, পাশে থাকার চেষ্টা করুন। প্রতিটা মানুষেরই একজন Imaginary friend বা কাল্পনিক বন্ধু থাকে।