ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ইটভাটার দূষণ, পরিবেশ ও বিপন্ন জনস্বাস্থ্য

অলোক আচার্য, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
ইটভাটার দূষণ, পরিবেশ ও বিপন্ন জনস্বাস্থ্য

মানুষ নানাভাবে পরিবেশ দূষণ করছে। শিল্পায়ন এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সুস্থ পরিবেশ আজ অসুস্থ। এর মধ্যে ইটভাটার দূষণে বিপন্ন হচ্ছে দেশের পরিবেশ। আধুনিক নির্মাণ সভ্যতায় ইটের বিকল্প নেই। আবার এই আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের উপকরণেই সভ্যতা ধ্বংস হচ্ছে। সভ্যতার মূল উপাদান হলো পরিবেশ। মুখে আমরা পরিবেশ রক্ষা করার কথা বলছি বটে, আমাদের কাজ কিন্তু তার বিপক্ষে। সারা বিশ্বেই ইটের ব্যবহার রয়েছে। ইট দিয়ে একের পর এক উঁচু অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে। এই চাহিদা সামাল দিতেই একের পর এক ইটভাটা তৈরি হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশের বিষয়টি মাথায় ছিল না। যখন দেখা গেল ইট কাঠের সভ্যতা নির্মাণ করতে গিয়ে পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে ফেলছে, তখন মানুষ সজাগ হলো। ইটভাটা নিয়ন্ত্রণে আইন হলো। কিন্তু তাতেও দূষণ ঠেকানো যাচ্ছে না। পরিবেশের তোয়াক্কা না করেই গড়ে উঠেছে বহু ইটভাটা। আইনকে তারা থোরাই কেয়ার করে। এসব অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে মাঝেমধ্যে কতৃপক্ষ অভিযান চালায়। কিন্তু তাদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যায় না। পরিবেশ ধ্বংসের বিনিময়ে এরা অর্থের পাহাড় গড়ে তোলো। এক তথ্যে দেখা যায়, সমগ্র বিশ্বে বছরে প্রায় ১৫০০ বিলিয়ন ইট উৎপাদিত হয়। ইটের ৬৭ শতাংশ চীনে, ২১ শতাংশ দক্ষিণ এশিয়ায় এবং বাকি ১২ শতাংশ বিশ্বের অন্যান্য দেশে উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় বছরে উৎপাদিত হয় প্রায় ৩১০ বিলিয়ন ইট। খুব দ্রুত সারা দেশে টিনের ঘরের জায়গায় পাকা ইমারত নির্মিত হচ্ছে। আর এ জন্য প্রয়োজন হচ্ছে প্রচুর সংখ্যক ইট। কিন্তু ইট তৈরির সনাতন পদ্ধতি যা পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী সেটাই পরিবেশের ক্ষতি করছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে বায়ুদূষণের জন্য ৫৬ শতাংশই দায়ী হলো ইটভাটা। ইটভাটা থেকে বায়ুমণ্ডলে যেসব দূষিত উপাদান যোগ হচ্ছে, এর মধ্যে পার্টিকুলেট ম্যাটার, কার্বন মনোঅক্সাইড, সালফার অক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইড উল্লেখযোগ্য। ২০১৯ সালে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ছিল ২০২৫ সালের মধ্যে মাটির ইট ব্যবহার পর্যায়ক্রমে পুরোপুরি বন্ধ করা। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০২৫ সালের পরিবর্তে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।

যদিও ইটের বিকল্প উৎসাহিত করতে সরকার আইন প্রণোয়ন করেছে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পোড়া ইটের বদলে ব্লক ব্যবহারে উৎসাহিত করতে জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করা হয়। ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) বিল-২০১৩’ সংশোধনের জন্য সংসদে একটি বিল উত্থাপন করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সংসদে সেই বিল পাস হওয়ার পর একই বছরের ২৪ নভেম্বর মন্ত্রণালয় থেকে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত ২০১৯)-এর ধারা ৫(৩ক)-এ দেওয়া ক্ষমতাবলে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মাটির ব্যবহার পর্যায়ক্রমে কমানোর উদ্দেশ্যে সব সরকারি নির্মাণ, মেরামত ও সংস্কার কাজে ভবনের দেয়াল ও সীমানা প্রাচীর, রাস্তা এবং গ্রাম সড়ক টাইপ-বি’র ক্ষেত্রে ইটের বিকল্প হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে ব্লক ব্যবহার বাধ্যতামূলক। কিন্তু তা মেনে চলছে কতজন সেটাই প্রশ্নের। চিরাচরিত ইট দিয়েই দালানকোঠা তৈরি হচ্ছে। দেশে চিরাচরিত ইটভাটার সংখ্যা সাত হাজারের বেশি হলেও ব্লক তৈরির প্রতিষ্ঠান মাত্র ৪০টির মতো রয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পর্যাপ্ত ব্লক পাওয়া কষ্টসাধ্য। এইসব ইটভাটা থেকে বছরে ২৩ বিলিয়নের বেশি ইট উৎপাদিত হচ্ছে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। সেই প্রতিবেদনে আরো জানা গেছে, বছরে প্রায় ৫ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন টন কয়লা ইটখোলাগুলোয় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে ইট তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাটি। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বছরে প্রায় ৩৩ হাজার ৫০ মিলিয়ন ঘনফুট মাটি ইট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। দেশে বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইট তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে ফিক্সড চিমনি সবচেয়ে পুরনো পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে ধোঁয়া নির্গমনের জন্য প্রায় ১২০ ফুট লম্বা চিমনি ব্যবহৃত হয়। ওই পদ্ধতিতে দেশে প্রায় ৪ হাজার ৫০০ ইটভাটায় ইট তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে জিগজাগ, হাইব্রিড হফম্যান ও টানেল পদ্ধতিতেও ইট তৈরি হচ্ছে।

এগুলোর মধ্যে টানেল পদ্ধতি সবচেয়ে আধুনিক এবং অনেকটা পরিবেশবান্ধব; যদিও এ পদ্ধতিতে ইট উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা খুবই কম। পরিবেশগত দিক বিবেচনায় সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের প্রচলিত ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু এর মধ্যে বিকল্প হিসেবে ব্লকের পর্যাপ্ত যোগানও দিতে হবে। কারণ উন্নয়ন কার্যক্রমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ইট। না হলে তার অবস্থা পলিথিনের মতো হবে। বিকল্প না থাকায় যেমন বাজারে দেদারছে পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। অনেকটা সেরকমই। ইটভাটাগুলোর কারণে বহুমুখী ক্ষতি হলেও প্রধানত দুটি ক্ষতি বেশি উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ইট তৈরির প্রধান উপাদান হলো মাটি। এভাবে ইট তৈরির ফলে মাটির উপরিভাগ বিনষ্ট হচ্ছে। এতে মাটি তার উর্বরতাশক্তি হারাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে একসময় তা কৃষিজ পণ্য উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে। এর পরেই আসে বায়ুদূষণের কথা। ইটভাটা থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে ব্যাপক বায়ুদূষণ হচ্ছে। এক গবেষণায় দেখা যায়, বছরে প্রায় ১৫ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন টন কার্বন ডাইঅক্সাইড ইটভাটা থেকে বায়ুমন্ডলে যোগ হচ্ছে। বিশ্বের কথা বাদ দেই। আমাদের দেশে অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ক্ষতি আরো বেশি হচ্ছে এর পাশাপাশি বনায়ন ধ্বংস করে পরিবেশ বিষিয়ে তুলছি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইটভাটার কারণে পরিবেশদূষণ, ভূমির উর্বরতা হ্রাস ও বন উজাড় হচ্ছে। কৃষিজমি দিন দিন কমছে। ইটভাটাতে মাটির জোগান দিতে ফসলের জমি অকেজো গর্তে পরিণত হচ্ছে। শুধু সমতল ভূমি নয়, কোথাও কোথাও পাহাড় পর্যন্ত কাটা হয় ইটভাটার মাটি জোগাড় করার জন্য। এমনকি ইট তৈরির জন্য কাঁচা মাটিও বিদেশে পাচার করা হচ্ছে।

পরিবেশ পরিবর্তনের জন্য দায়ী মূলত মানুষের কর্মকাণ্ড। পরিবেশ পরিবর্তনের অর্থ হলো জলবায়ু পরিবর্তন। এই যেমন এই শীতে শৈত্যপ্রবাহের কারণে জনজীবন প্রায় বিপর্যস্ত।

আবার গত বছর ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন বহুমুখী। অর্থাৎ জলবায়ুর কারণে আমাদের ক্ষতির বোঝা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব জিওগ্রাফির একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, প্রবল গরম ও খরার মুখোমুখি হতে চলেছে বিশ্বের ৯০ শতাংশ মানুষ। আমাদের দেশে পরিবেশ দূষণের একটি বড় কারণ হলো এসব ইটভাটা। ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চলে ইটখোলা থেকে ৫৩ হাজার ৩৩৩ টনের বেশি পার্টিকুলেট ম্যাটার-১০ বায়ুমণ্ডলে যোগ হয়েছে। অন্যদিকে ১৭ হাজার ৫৫৭ টন পার্টিকুলেট ম্যাটার-২.৫ এবং ৫৯ হাজার ২২১ টনেরও বেশি সালফার অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে যোগ হয়েছে। সচরাচর মানুষজন বসবাস করে এমন স্থান থেকে দূরে ইটভাটা তৈরি করার কথা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। ফলে ইটভাটার আশপাশে যারা বাস করছে তারা মারাত্মক দূষণের শিকার হচ্ছে। ইটখোলার আশপাশে বসবাসরত মানুষ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। জাতিসংঘের ধারণামতে, ইটভাটার মাধ্যমে বাংলাদেশের পরিবেশ সবচেয়ে বেশি দূষিত হয়। ঢাকার প্রায় ৪০ শতাংশ বায়ুদূষণের কারণ ঢাকার আশেপাশের ইটভাটা।

২ বছর আগের এক তথ্য থেকে জানা যায়, ঢাকাতে প্রতিবছর ৩ হাজার ৫০০ জন মারা যায় বায়ুদূষণের জন্যে। এভাবে চললে ২০৩০ সাল নাগাদ সাড়ে ৩ কোটি মানুষ বায়ুদূষণজনিত স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগবে। এছাড়া বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি মানুষ বায়ুদূষণের জন্যে স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চায় নাগরিক জীবন। সবার আগে দূষণ কমানো প্রয়োজন। আর এ কারণে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া এবং যত দ্রুত সম্ভব সনাতন পদ্ধতির পোড়ানো ইটের বিকল্প ব্লক ব্যবহার বৃদ্ধি করা দরকার।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত