সাইবার ক্রাইম রোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে

আফতাব চৌধুরী

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, যেভাবে বিশ্বজুড়ে এ অপরাধ বাড়ছে, তাতে আগামী বছরগুলোতে অবস্থা খুবই ভয়াবহ হয়ে পড়ে উঠতে পারে। ইন্টারনেটের গ্রাহক বৃদ্ধি, মূল্যবোধের অভাব এবং সচেতনতাই এসব অপরাধ বাড়ার মূল কারণ। এ অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য সচেতনতা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করার কথাও বলছেন তারা। কোনো কোনো কাজ সাইবার ক্রাইম হিসাবে গণ্য?

১. ইন্টারনেটের মাধ্যমে কম্পিউটার, নেটওয়ার্ক পরিকাঠামোকে সরাসরি আক্রমণ। ২. ইন্টারনেটের মাধ্যমে ব্যক্তিবিশেষ ও জাতীয় নিরাপত্তায় ব্যাঘাত ঘটানো। ৩. মেলওয়্যার স্প্যামিং বা জাঙ্ক মেইল। ৪. ই-মেইল বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করে কাউকে হুমকি দেয়া, কোনো ব্যক্তির নামে মিথ্যাচার বা অপপ্রচার, মহিলাদের অবমাননা, যৌন হয়রানি। ৫. কারও আইডির লগইন বা অ্যাকসেস তথ্য চুরি। ৬. ইন্টারনেট থেকে তথ্য চুরি করে ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা লুট। ৭. সাইবার জগতে মাদক ব্যবসা। ৮. পাইরেসি, সদ্য প্রকাশিত গান ও সিনেমার ফাইল ইন্টারনেটে শেয়ার।

৯. ব্লগ ও ওয়েবসাইট থেকে কোনো লেখা ও ছবি নকল বা নিজের নামে ব্যবহার। ১০. পর্নোগ্রাফি। ১১. ব্যক্তিগত তথ্য পরিচয় ছবি চুরি। ১২. হ্যাকিং। ১৩. গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কিংবা ক্রেডিট কার্ড নাম্বার চুরি করে গোপন অনলাইন ব্যাংক থেকে অর্থ চুরি করা। সাইবার অপরাধের বিচারের জন্য বর্তমানে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন রয়েছে।

এ আইনের বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী, কম্পিউটার বা কম্পিউটার সিস্টেম ইত্যাদির ক্ষতি, অনিষ্ট সাধন, যেমন ই-মেইল পাঠানো, ভাইরাস ছড়ানো, সিস্টেমে অনধিকার প্রবেশ বা সিস্টেমের ক্ষতি করা ইত্যাদি অপরাধের শাস্তি জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়া কেউ যদি ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে এমন কেনো কাজ করে, যার ফলে কোনো কম্পিউটার রিসোর্সের তথ্য বিনাশ, বাতিল বা পরিবর্তিত হয় বা এর উপযোগিতা হ্রাস পায় অথবা কোনো কম্পিউটার, সার্ভার, নেটওয়ার্ক বা কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেমে অবৈধভাবে প্রবেশ করে, তবে এটি হবে হ্যাকিং অপরাধের জন্যও কারাদণ্ড এবং জরিমানার সংস্থান রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কোনো মিথ্যা বা অশ্লীল কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করে, যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি হয় অথবা রাষ্ট্র বা ব্যক্তির ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়, তাহলে এগুলো হবে অপরাধ। এর শাস্তি কারাদণ্ড এবং জরিমানা।

এত কঠিন শাস্তির আইন থাকলেও থামছে না সাইবার অপরাধ। দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। বিশ্বজুড়েই দেখা যাচ্ছে মহিলারাই সব থেকে বেশি সাইবার ক্রাইমের শিকার হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে এসব অপরাধ বেশি পরিমাণে সংগঠিত হচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন সময়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে বাড়ছে অশ্লীলতা। একশ্রেণির তরুণী ফেসবুক লাইভে নিজেকে অশ্লীলভাবে উপস্থাপন করছে, যা পরে ইউটিউবসহ অন্যান্য ভিডিও মাধ্যমগুলোতে ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সম্প্রতি বিভিন্ন আইডির লগ ইন বা অ্যাকসেস তথ্য চুরি, ইন্টারনেটের মাধ্যমে হুমকি, মিথ্যাচার বা অপপ্রচারসহ এ অপরাধের আওতায় থাকা অন্যান্য অপরাধও সংগঠিত হচ্ছে। অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর মধ্যে বেশির ভাগই নতুন। মানুষ ইন্টারনেটমুখী হওয়ার কারণে এসব অপরাধও বাড়ছে। মূল্যবোধ আর সচেতনতার অভাবকেই দায়ী করছেন তারা।

এ বিষয়ে ক্রিমিনোলজি (অপরাধতত্ত্ব) বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য হলো, এখন বিশ্বজুড়ে ইন্টারনেটের গ্রাহক বহুগুণ বেড়ে গেছে, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার বেড়ে গেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে; কিন্তু এক দশক আগেও এরকম সব কিছু ছিল না। এটা আমাদের কাছে অপরিচিত ছিল। এখন সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। তাই অপরাধের ধরনগুলোও পরিবর্তন হচ্ছে। তারা আরও বলেন, সাইবার ক্রাইম এখন সবখানেই হচ্ছে। আমেরিকা, কানাডা, ইউরোপসহ অনেক উন্নত দেশগুলোতে এসব নিয়ন্ত্রণে উন্নত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকলেও সেসব দেশেও ব্যাংকের এটিএম কার্ড জালিয়াতি হচ্ছে। তবে এশিয়া, আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে অবস্থা ভয়াবহ হতে পারে। তাই এগুলোর দিকে গুরুত্ব সহকারে নজর দিতে হবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করে চললেও অপরাধীরা আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানা ধরনের অপরাধ করছে।

এসব অপরাধ দমনে নিত্যনতুন আইন প্রণয়নের প্রয়োজন বাড়ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধু আইন প্রণয়ন নয়, প্রয়োগের বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক সচেতনতাও বাড়তে হবে। শুধু আইন হলে চলবে না, যথাযথভাবে আইন প্রয়োগের দরকার। এখন সব কিছুই অনলাইন হয়ে গেছে। যখন চারদিকে অনলাইনের জোয়ার তৈরি হয়, তখন মানুষের প্রতিক্রিয়া হয়। মানুষ প্রযুক্তিমুখী হওয়ার কারণে এ ক্রাইম বাড়ছে। আমাদের সমাজব্যবস্থা আগের থেকে আধুনিক হচ্ছে। এ অবস্থায় নানা ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।

এ উপসর্গগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে সাইবার ক্রাইম। আমাদের মধ্যে সচেতনতার হারটা অনেক কম। মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে। মূল্যবোধের অধঃপতনও এ অপরাধের অন্যতম কারণ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর শক্ত ভূমিকাও সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। আইন কঠোর এবং শাস্তির বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারলেই এ অপরাধ প্রবণতা কমে আসতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট