মানুষের আস্থার প্রতিদান দিতে হবে সরকারকে

নীলকণ্ঠ আইচ মজুমদার, লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।

প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষায় বিএনপিবিহীন নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামীলী গ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। পশ্চিমা দেশের চাপের কাছে মাথা নত না করে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন বন্ধ না করে এগিয়ে যান দ্রুত গতিতে।

নির্বাচনের তিন দিন পর ১০ জানুয়ারি নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করেন স্পিকারের কাছে। এরপর দিন রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা। ভিন্ন রকমের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বর্তমান সরকারের যাত্রা শুরু হলো এ কথা বলা চলে। যদিও নির্বাচন নিয়ে সবসময় একটা চ্যালেঞ্জের মধ্যেই ছিলেন, বর্তমান সরকারপ্রধান ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের শুরুতেই বিএনপি নির্বাচনে আসবে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সংশয় ছিল। শেষে সেই সংশয়ই সত্যি হয়। বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে জনসাধারণকে ভোট বর্জনের আহ্বান জানান। তারা হরতাল-অবরোধ ও নির্বাচন বর্জনের জন্য লিফলেট বিতরণ করে। বিএনপি দাবি করছে তাদের আন্দোলন সফল হয়েছে, অন্যদিকে সরকার বলছে বিএনপির আবেদন সাধারণ মানুষ প্রত্যাখ্যান করেছে। স্বাভাবিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, দুপক্ষের কথারই কিছুটা সত্যতা রয়েছে। কারণ ভোটারের উপস্থিতি সরকারকে কিছুটা হলেও বিব্রত করেছে। তবে আন্দোলনে বিএনপি যে সফল হয়েছে, সে কথাও বলা চলে না। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কত শতাংশ ভোট হলে, সেটা গ্রহণযোগ্য সেটা বলা নেই। অন্যদিকে উপস্থিতি একেবারেই হেলাফেলা করার মতো না। ভোটার উপস্থিতি কম হলেও যারা ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়েছে তারা সহজেই ভোট দিতে পেরেছে এবং তাদের মতের প্রতিফলন ঘটেছে, এটা সত্য যা গণতন্ত্রের জন্য একান্ত কাম্য। অধিক ভোটারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা না গেলেও ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল একথা বলা চলে। দুএকটি বিছিন্ন ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে, এটা অসত্য নয়। নির্বাচনের পর সরকার গঠন নিয়েও উত্তেজনা ছিল সবার মাঝে। সংসদীয় গণতন্ত্রে মন্ত্রিপরিষদ নিয়োগের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর উপর। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী ২৫ জন মন্ত্রী ও ১১ জন প্রতিমন্ত্রী নিয়োগ দেন। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশ এই সরকারকে অভিনন্দন জানাতে থাকে এবং একসাথে কাজ করে যাবে বলে আশস্ত করে যাচ্ছেন। নির্বাচনের আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্র এ নির্বাচনের বিরোধীতা করে আসছিল এবং এ নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার চিন্তা করছিল। কিন্তু সরকার যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করার ব্যাপারে ছিল বদ্ধপরিকর। তাই বলা চলে নানা সমীকরণে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। এখন আলোচ্য বিষয় হলো সামনের সময়ে কি কি চ্যালেঞ্জ রয়েছে সরকারের? এইসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কীভাবে এগিয়ে যাবে? এরই মধ্যে দেশ উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং মডেল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সামনে রয়েছে আরো বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে যেসব বড় বড় প্রকল্প বিদেশিদের সহায়তায় বাস্তবায়ন হচ্ছে সেগুলো পড়তে পারে চ্যালেঞ্জের মুখে। একদিকে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিভিন্ন কর্মসূচি অন্যদিকে বহিঃবিশ্বের নানামুখি চাপ। এছাড়া গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে বিদেশি প্রভূদের সন্তুষ্ট রাখা বড় কষ্টসাধ্য কাজ হয়ে দাঁড়াবে বলেই মনেই হয়। তবে একথা মানতে হবে যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন চাপ মাথায় নিয়েই বলা চলে একহাতে সামলে যাচ্ছেন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ। এরই মধ্যে নতুন পুরাতনের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে মন্ত্রিসভা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণে যারা সমালোচিত হয়েছেন তাদের বাদ রাখা হয়েছে এবারের মন্ত্রিসভায়। বিশিষ্টজনদের মতে এবারের মন্ত্রিসভা তুলনামূলকভাবে অনেক স্মার্ট হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। যদিও এর প্রমাণ পাওয়া যাবে তাদের কার্যক্রমে। আপাতত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কূটনীতিতে অস্বস্তি কাটানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। সামনের সময়গুলোতে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন রকমের পথ খুঁজবে, যেহেতু তাদের কথা মতো নির্বাচন করা হয়নি। বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বাঁধা তৈরি করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য থাকবে দেশের অর্থনীতির উপর প্রভাব বিস্তার করা। সেজন্য তারা বিরোধী দলীয় শক্তিকে ব্যবহার করতে চাইবে আর যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে আসে নাই, তাই তারা চাইবে যেকোনো মূল্যে দেশের সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে এ কারণে অর্থনৈতিকভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হতে পারে সরকার। সংসদেও বিরাজ করতে পারে অশান্তি। কারণ বিরোধী দল হিসেবে জাপা তাদের নিজেদের দল ঠিক রাখতে হিমশিম খাচ্ছে-এর প্রভাব পড়তে পারে সংসদেও। অন্যদিকে স্বতন্ত্ররাও সরকারের লোক হিসেবেই সংসদে থাকতে আগ্রহী বেশি। তাই সংসদ হতে পারে প্রাণহীন যা গণতন্ত্রের জন্য শোভনীয় নয়। সামনে আসছে উপজেলা নির্বাচন আর এ নির্বাচনে বিএনপি না আসার সম্ভাবনাই বেশি। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদের মতো এ নির্বাচনও হবে দলীয় লোকদের মাঝে। দলীয় লোকরা একে অন্যের প্রতিপক্ষ হওয়ায় দলে বাড়ছে বিভেদ। যে বিভেদ সামনে আরো জটিল আকার ধারণ করতে পারে। একসময় তা চলে যাবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং ভেঙে পড়তে পারে দলের চেইন অফ কমান্ড। এরই মধ্যে সাধারণ জনগণের মাঝে বর্তমান সরকারের উপর আস্থা পরিলক্ষিত হতে শুরু করেছে। তবে সবচেয়ে সমস্যাটা হলো দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। মানুষের মাঝে এ বিষয়টি চরম হতাশা বিরাজ করছে। একসময় করোনা ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কথা বলা হলেও এগুলো আর মানতে নারাজ সাধারণ মানুষ। মানুষ চায় কাজ করতে শান্তিতে চারটা ভাত খেতে তাই এ নিশ্চয়তা সরকারকে দিতে হবে। অন্যদিকে বিএনপিকে ভবিষ্যতে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে বিদেশি নির্ভরতা কমাতে হবে। তাদের এটাই মনে রাখতে হবে, যে সঠিক নেতৃত্বের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সরকারের বিভিন্ন কাজের সমালোচনা করতে হবে। আমাদের দেশে কোনো সরকারের আমলেই বিরোধীদের রাজনীতি করা সহজ ছিল না। কঠিন পথ পাড়ি দিয়েই সামনে এগুতে হয়েছে। বিরোধী নেতাকর্মীর ওপর হামলা মামলা কোনো সময়ই কম ছিল না। তাই রাজনীতি হতে হবে দেশের জনগণের সঙ্গে ও মাঝে দেশকে বাঁচিয়ে। না হলে হতে হবে দেশবিরোধী। অন্যদিকে সরকারকে মানুষের আস্থা ধরে রাখার জন্য সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করতে হবে এবং বিরোধীদেরও রাজনীতি করা সুযোগ দিতে হবে। জনগণ যদি তাদের আস্থার প্রতিদান না পায়, তাহলে সুযোগ মতো তারাই মুখ ফিরিয়ে নিবে। কারণ যে দলই আন্দোলন করুক তাতে জনগণের অংশগ্রহণ না থাকলে আন্দোলনে সফল হওয়া যাবে না। তাই সবক্ষেত্রেই জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে।