ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

স্থানীয় সরকার নির্বাচন : দলীয় প্রতীক বাতিল ইতিবাচক দিক

শফিকুল ইসলাম খোকন, লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক
স্থানীয় সরকার নির্বাচন : দলীয় প্রতীক বাতিল ইতিবাচক দিক

পুরোনো কথা আবার নতুন করে বলতে হয়; কাউকে বিভ্রান্ত করতে হলে অন্যের মতামত চাপিয়ে দিতে হয়। একটি পরিবার ধ্বংস করতে চাইলে পরিবারটির একতাকে নষ্ট করতে হয়। একটি সমাজকে ধ্বংস করার আগে তার মূল্যবোধ ধ্বংস করতে হয়। একইভাবে একটি দেশকে ধ্বংস করার আগে তার দীর্ঘদিনের সংস্কৃতিকে আঘাত করতে হয়। একটি রাষ্ট্রের সংস্কৃতিকে আঘাত করা মানেই সেই দেশটির ইতিহাস-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে দেয়া। বাঙালির প্রাচীন সংস্কৃতিতে রয়েছে দীর্ঘকালের সামাজিক রীতিনীতি, স্থানীয়তা, আত্মীয়তা ও আঞ্চলিকতার বন্ধন। অর্থাৎ স্থানীয়রা দীর্ঘকাল ধরে এক ধরনের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে বসবাস করে আসছে। আর যদি সেই স্থানীয়তে তথা ‘স্থানীয় সরকার’ দলীয়করণ করা হয় তাহলে মুহূর্তেই সেই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংস হয়ে যাবে। যদিও আমরা মনে করি, গণতন্ত্রের মুল ভিত্তি বা স্ত¤¦ হলো স্থানীয় সরকার। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক স্তম্ভ, প্রাচীণ সংস্কৃতি বা স্থানীয়তা ধ্বংস করে রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আনা হয়েছিল।

২০১৫ সালে একক সিদ্ধান্ত বা জোর জবরদস্তির মাধ্যমে কালো আইন পাস করা হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে গত কয়েক বছর ধরে প্রাচীণ সংস্কৃতি, দীর্ঘকালের সামাজিক রীতিনীতি, স্থানীয়তা, আঞ্চলিকতা, আত্মীয়তা ধ্বংস হয়ে গেছে। অর্থাৎ স্থানীয় সরকার যে স্থানীয়দের কাছের সরকার বা প্রতিষ্ঠান সেটা ভুলে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তথা দূরবর্তী সরকারের দ্বারস্ত হতে বাধ্য করেছিল। কিন্তু একটি কথা সবাই জানেন, ক্ষনস্থায়ী কোনো বিষয় স্থায়িত্ব থাকে না অর্থাৎ অপরিকল্পিত কোনো কাজই টেকসই হয় না বা তার জীবদ্দশা নড়বড়ে থাকে। যা আমরা বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে দেখে আসছি। দলীয় প্রতিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে যা হয়েছে তা হলো প্রতিহিংসা, সহিংসতা, আভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, পদ বাণিজ্য, মনোনয়ন বাণিজ্য, পারিবারিক কোন্দল ইত্যাদি। যদিও তখন সরকার প্রধান যে উদ্দেশ্যে এ আইন পাস করেছিলেন, হয়তো সেটি বাস্তবায়নও হয়েছে। তবে আমি যদি বিতর্কে না গিয়ে একেবারে সাদামাটা কথা বলি তা হলো- তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা উন্নয়ন তৃণমূলে পৌঁছানোর জন্য বা কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে স্থানীয় সরকারের সম্পর্ক ত্বরান্বিত বা গভীর করার জন্য এ আইন পাস করেছিল তাহলে আমি বলব তা একেবারেই সফল হয়নি।

সিটি-উপজেলা নির্বাচন, নৌকা প্রতীক থাকবে না, দলের যে কেউ অংশ নিতে পারবেন প্রধানমন্ত্রীর এমন সিদ্ধান্তে পরবর্তী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচন নিয়ে এখন জোড়েশোরে আলোচনা শুরু হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের বাইরেও দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করার জন্য নির্দেশনা দেওয়াতে আওয়ামী লীগ থেকে এমন সিদ্ধান্ত আসবে আমি আশঙ্কা করেছিলাম। আর সেটাই হলো। তাছাড়া ২০১৫ সালে দলীয় প্রতিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যে আইন করা হয়েছিল তার বিরুদ্ধেও কলম চালিয়েছিলাম। তখনও আশঙ্কা করেছিলাম, আজ হোক কাল হোক, এ নিয়মও বাতিল হবে। যা ২০২৪ সালে এসে তার আলোর মুখ দেখছি। স্থানীয় সরকারের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে চেয়ারম্যান এবং মেয়র পদে দলীয় প্রতিকে ভোট করার বিধান করে আওয়ামী সরকার। যে সিদ্ধান্তটি ছিল নিজের পায়ে কুড়াল মারা; তবে আওয়ামী লীগ অনেক পর হলেও তাদের বোধদয় হয়েছে। তাদের এ সিদ্ধান্তের ফলে যেমন আভ্যন্তরীণ কোন্দল, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, প্রতিহিংসাপরায়ণতা, মনোনয়ন বাণিজ্য কমেছে, তেমনি তৃণমূলে স্বতঃস্ফূর্ত এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সর্বমহলে নির্বাচন নিয়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতামূলক নির্বাচন হবে এবং নির্বাচনের প্রতি গণমানুষের বিশ্বস্ততা ফিরে আসবে। এছাড়াও বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল আগের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। যার ফলে বিএনপির রাজনৈতিক দৈন্যদশা থেকে ফিরে আসবে। এছাড়াও বিএনপির তৃণমূল মজবুত হওয়া মানেই কেন্দ্রীয় পর্যায় সংগঠিত হওয়া। আমি মনে করি এটি আওয়ামী লীগ ও বিএনপপির দুদলের জন্যই মঙ্গল; আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক মহল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখাতে পারবে, বড় একটি অপবাদ থেকে মুক্তি মিলবে এবং বিএনপিও এ সুযোগে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দলকে সংগঠিত করবে। যার ফলে ভোটাররাও তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে।

২০১৫ সালের ১২ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদে নীতিগত অনুমোদনের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন দলীয়ভাবে করার জন্য স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ সংশোধন আইন-২০১৫, উপজেলা পরিষদ সংশোধন আইন-২০১৫, জেলা পরিষদ সংশোধন আইন-২০১৫ ও সিটি করপোরেশন সংশোধন আইন-২০১৫ এর খসড়া নীতিগতভাবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। সেই থেকেই স্থানীয় সরকারের সবস্তরের নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ও ব্যানার ব্যবহার করেন প্রার্থীরা। স্থানীয় সরকারভুক্ত আরেক প্রতিষ্ঠান জেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ সংশোধন আইন-২০১৫ গঠিত হলেও এটি অনির্বাচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। যেটা আইনের ব্যত্যয় হচ্ছে। বর্তমান সরকার আবার স্থানীয় সরকারের সেই প্রাচীন রুপে যেতে চায়। এর মধ্যেই উপজেলা নির্বাচনে তারা দলীয় প্রতীক দেবে না বলে ঘোষণা দেয়। সে হিসেবে আইনের সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো দল যদি কাউকে মনোনয়ন দেয়, প্রতীক দেয়, সেখানে তার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হবে। এছাড়া আরো বিকল্প আছে। কোনো দল যদি মনে করে, তারা মনোনয়ন দেবে না কিংবা কোথাও দেবে, কোথাও দেবে না, সেক্ষেত্রেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ আছে। কেউ স্বতন্ত্র নির্বাচনও করতে পারে। আইন সংশোধনের কোনো প্রয়োজন নেই জানিয়ে তিনি আরো বলেন, আইন সংশোধনের কোনো দরকার পড়বে না। আমি আইনটি দেখেছি, আইন ঠিক আছে।’ (সূত্র প্রতিদিনের সংবাদ, তারিখ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৪)। যদি তাই হয়, তাহলে ২০১৫ সালে কেন এতো ঘটা করে স্থানীয় সরকার আইনে সংশোধনী আনা হয়েছে? এমন প্রশ্ন কিন্তু পাঠকের মাঝে থাকতেই পারে। তাছাড়া বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ২০২১ সালের ১১ মার্চে প্রজ্ঞাপন দিয়ে যে গেজেট প্রকাশ করেছেন, ওই গেজেটে উপজেলা পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এর ধারা ৬৩ এর উপ ধারা ২০-এর ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিবিধমালা, ২০১৩ অধিকতর সংশোধন করে যে গেজেট প্রকাশ করেছেন তার তফসিল২ (বিধি ২২(১)(ক) অনুযায়ী নৌকা, ধানের শীষসহ ৩৯টি রাজনৈতিক দলের প্রতিক দেয়া রয়েছে। তাহলে ওই গেজেট বা প্রজ্ঞাপন কি রহিত বা সংশোধন হবে না? এমন প্রশ্ন কর্তাদের কাছে পাঠকের।

আমরা দেখছি, যে কোনো সরকারি দল তাদের মতো করে আইন সংশোধন করছে। অথচ যা হওয়া উচিত ছিল, এ আইনের উপকারভোগি কারা। বিদ্যমান আইনে কতভাগ মানুষ উপকৃত হবেন অথবা নতুন আইন প্রণীত হলে কতভাগ মানুষ উপকৃত হবেন। এসব বিবেচনা না করেই হুট করে আমরা আইন সংশোধন করে ফেলছি। অথচ আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে খসড়ার করার সময়ই অধিকাংশ মানুষ যেখানে বসবাস বসবাস করছে সেখানের মানুষদের মাঝে জরিপ করে, যথাযথ মূল্যায়ন করে, তৃণমূল থেকে সবার সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার প্রয়োজনীয়তা রক্ষা করা উচিত। কিন্তু আমরা সেটি করছি না। শুধু আইন পাস করলেই হবে না, এটি জনগণের জন্য কতটুকু সুফল বয়ে আনবে সেটি মুখ্য বিষয়। এগুলো সঠিকভাবে বিবেচনা করলে বার বার আইন সংশোধন করার দরকার হবেনা, সরকারের টাকাও ব্যয় হবে না।

আমরা জানি, আধুনিক সমাজে গণতন্ত্র একটি স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা। এখানে সবকিছু হয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের মাধ্যমে। একক সিদ্ধান্ত বা জোর-জবরদস্তির কোনো সুযোগ নেই। কাগজে কলমে স্থানীয় সরকার নিরপেক্ষ থাকলে বিগত বছরগুলোতে নির্বাচনগুলো দলীয় মনোনয়ন নিয়েই রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরাই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বিষয়টি প্রকাশ্য স্ববিরোধিতা এবং স্থানীয় সরকার আইনের সুস্পষ্ট লংঘন হলেও সরকারের ভূমিকা ছিল নীরব। স্থানীয় সরকার স্বাধীন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার বিরোধীতা করে স্থানীয় বিষয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গর্ভন্যান্স (সিডিএলজি)সহ সুধীসমাজের বরাবরই আপত্তি ছিল। যেটি ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতিকে আইন সংশোধন করার সময় আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। এর সপক্ষে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে যুক্তি ছিল, স্থানীয় সরকারের জন্মলগ্ন থেকেই নির্বাচন নির্দলীয় ছিল। কালের বিবর্তনে এ ঐতিহ্য হারিয়ে যায়। সিটি করপোরেশনসহ কিছুসংখ্যক পৌরসভা ও উপজেলা নির্বাচন অলিখিতভাবে দলীয় ভিত্তিতে শুরু হয়। আইনে বিষয়টি স্বীকৃত না হলেও বাস্তবে বিষয়টি দৃশ্যমান ছিল। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন যেভাবে চলছে এভাবেই থাকা সমীচীন। তা না হলে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়বে। হিংসা, বিদ্বেশ, হানাহানি, দলীয় ব্যানারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বাড়বে। ফলে স্থানীয় সরকার স্বাধীনের নামে চলবে হরিলুট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। গণতন্ত্রের মূলভিত্তি বা স্তম্ভ স্থানীয় সরকার হলেও বাস্তবে কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে এটি আমরা সকলেই জানি। আর যখন দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হবে, তখন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অনেক কর্মকাণ্ড করে পাড় পেয়ে যাবে অপরাধীরা। আর দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে এবং তা বাস্তবে রূপ নিলে এটি একটি কালো অধ্যায়ের সূচনা ছাড়া আর কিছুই হবে না। যেটি গত কয়েক বছর ধরে দেশের জনগণ দেখছে। স্থানীয় সরকার যেভাবে ছিল, সেভাবেই থাকা সমীচীন। তা না হলে রাজনৈতিক সহিংসতা বাড়বে। হিংসা, বিদ্বেশ, হানাহানি, দলীয় ব্যানারে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ইত্যাদি বাড়বে। ফলে স্থানীয় সরকার স্বাধীনের নামে চলবে হরিলুট ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। গণতন্ত্রের মূলভিত্তি বা স্তম্ভ স্থানীয় সরকার হলেও বাস্তবে কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে, এটি আমরা সবাই জানি। আর যখন দলীয় প্রতিকে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয়, তখন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় অনেক কর্মকাণ্ড করে পাড় পেয়ে যায় অপরাধীরা। এমনটাই ধারণা ছিল, গত কয়েক বছর ধরে এরকমটাই দেখছে দেশের জনগণ।

আমরা দীর্ঘকাল ধরে দেখে আসছি, কারোর বাড়িতে আগুন লাগলে প্রথমে প্রতিবেশীরা ছুটে আসেন আগুন নেভানোর জন্য। অসুখ-বিসুখসহ নানা ধরনের বিপদে-আপদে একে অপরের সাহায্য করে থাকে এবং তাদের মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাবে থাকে না। সেখানে থাকে না কোনো ভেদাভেদ, থাকে না কোনো দ্বন্দ্ব, থাকে না হিংসা। আর যদি তারা দলীয়ভাবে একে অপরকে মূল্যয়ান করা শুরু করে তাহলে সমগ্র দেশটি দলবাজিতে ডুবে যাবে। আমরা জানি, জাতীয়তে তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে এক ধরনের অসুস্থ রাজনীতির চর্চা রয়েছে। সে রাজনীতি স্থানীয়তে চালু হোক এটা আশা করা উচিত নয়। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য স্থানীয় ও জাতীয়তে একইসঙ্গে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করা খুবই প্রয়োজন। প্রথমে স্থানীয়দের সরকার আলাদা করে সব কাজ স্থানীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে হবে (যেমন ইউনিয়ন সরকার, উপজেলা সরকার, জেলা সরকার, নগর সরকার)। আর যদি সরাসরি দলীয়করণ করা হয়, তাহলে স্থানীয় সরকার যেমন স্বশাসিত থাকবে না, তেমনি সহিংসতাও বৃদ্ধি পাবে। যারা আমেরিকা, কানাডা ও ইউরোপের উদাহরণ দেন তারা ভুলে যান যে, সেসব দেশে বহু আগেই গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা রয়েছে। বর্তমান আওয়ামী সরকার এটা অনেক পরে হলেও উপলব্দি করেছে বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে।

আসুন আমরা একটু ভেবে দেখি স্থানীয় সরকার দলীয় না হলে অর্থাৎ নির্দলীয় হলে সুবিধা-অসুবিধা কি কি? সমাজে বহু লোক আছেন, যারা প্রচলিত রাজনীতিতে আস্থা রাখেন না। কিন্তু স্থানীয় উন্নয়নে অবদান রাখতে চান। দলীয় ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন শুরু হলে তাদের জায়গা কোথায় থাকবে। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে তার এলাকার লোকরা আসে স্থানীয় সমস্যা নিয়ে। স্থানীয় বেশিরভাগ সমস্যাই হয়ে থাকে অরাজনৈতিক; স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় পদ্ধতিতে হলে স্থানীয় সমস্যা সমাধানে কিংবা স্থানীয় উন্নয়নে রাজনীতিকে অযথাই টেনে আনা হবে। তখন সব স্থানীয় কর্মকাণ্ডে এবং উন্নয়নে রাজনীতির বিষয়টি মুখ্য হয়ে দেখা দেবে। স্থানীয় প্রতিনিধিরা স্থানীয় উন্নয়ন চিন্তা বাদ দিয়ে জাতীয় রাজনীতি নিয়ে মশগুল থাকবেন। যদিও এরই মধ্যে তার বাস্তবতা আমাদের কাছে পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে কোনো বিষয় নিয়ে পক্ষ প্রতিপক্ষ হলেও শেষ মেস একটি বিষয় খেয়াল রাখে তারা একই স্থানের বাসিন্দা। তাদের ভুল বুঝাবুঝির অসবান হলে তখন আর হানাহানিতে লিপ্ত থাকে না, মিলে মিশে যায়। আর যখন দলীয় মনোভাব থাকবে, তখনই ওই কথাটি আর বিবেচনা করবে না। তখন দলীয়ভাবে এটি অনেক দূর পৌঁছায়, যার কুফল এর আগে অনেকেই দেখেছেন। সামান্য বিরোধ হলেও সেখানে রাজনীতি চলে আসে। রাজনৈতিক দলকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে স্থানীয় পর্যায় হানাহানিতে মেতে উঠেছিল।

পরিশেষে বলতে চাই, শেখ হাসিনার সরকার সেই প্রাচীণ সংস্কৃতিতে চলে আসছে এ জন্য ধন্যবাদ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্তম্ভ, স্থানীয়তা, আত্মীয়তা ও আঞ্চলিকতার বন্ধন ফিরিয়ে দিয়েছেন। দীর্ঘদিন থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এ দেশে সংগ্রাম চললেও বাস্তবে তার প্রয়োগ খুবই দুর্বল। তাই আধুনিক সমাজ বা রাষ্ট্রকে স্বীকৃত গণতান্ত্রিক পন্থায় গড়ে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক সমঅধিকারের ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় দেশ গড়তে হলে স্থানীয় সরকারকে স্বশাসিত এবং স্বাধীন করতে হবে। মনে রাখা দরকার, গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেও জাতীয়তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব। সে জন্য উপজেলা নির্বাচন নির্দলীয় করা হলে বিরোমী দলসহ যোগ্য ব্যক্তিদের অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি হবে। স্থানীয়ভাবে সমঅধিকার, সহমর্মিতা, আন্তরিকতা, গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহত থাকবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত