ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভাষা আন্দোলন

বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রচেষ্টায় ২১ ফেব্রুয়ারি পেয়েছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
দেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভাষা আন্দোলন

ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের ভাষার মাস, আমাদের চেতনার মাস। এই মাসটি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধিকার আন্দোলনের মূলমন্ত্র। কেননা পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আমাদের বঞ্চিত করার জন্য প্রথমেই আঘাত হানে বাংলা ভাষার অধিকার কেড়ে নেয়ার অপচেষ্টার মধ্য দিয়ে। তবে বীর বাঙালি সেই সুযোগ পাকিস্তানকে দেয়নি। ভাষা আন্দোলনের পথ পরিক্রমায় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এগিয়ে যায়। বাংলাদেশ অর্জন করে স্বাধীনতা। বাংলাদেশ নামটি বিশ্বে স্থান করে নেয় একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। সে কারণে ভাষা আন্দোলন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠার প্রথম সংগ্রাম। কেননা ভাষার ওপর আঘাত হেনে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যদি একবার পার পেয়ে যেত তবে আমাদের পরবর্তী স্বাধিকার আন্দোলনসমূহ হোচট খেত। কিন্তু সেই সুযোগ পায়নি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ভাষা এবং সম্প্রদায়ের আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। ভারত উপমহাদেশে ভাষার একটি বিস্তৃত অংশ বাংলা ভাষার অন্তর্গত। বাংলা ভাষা এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে লালিত হয়ে আসছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামে যে রাষ্ট্রটির সৃষ্টি হয়েছিল তার দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতেই সব দিক থেকে নানা স্বৈরাচারী মনোভাব এবং ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারণে শোষিত-বঞ্চিত হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তান। অনেক ভুলের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানকে উর্দু ভাষার রাষ্ট্রে পরিণত করার সিদ্ধান্তটি ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। যার কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি দুই অংশে বিভক্ত হওয়ার প্রথম সূত্রপাত ঘটেছিল। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য দেশব্যাপী দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল মূলত পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বাঙালির মৌলিক অধিকার রক্ষায় বাংলা ভাষাকে ঘিরে গণদাবির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও এর বীজ রোপিত হয় তারও বহু আগে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ- পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত বহু মৌলিক পার্থক্য ছিল। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাংলাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি করে। মানুষ আকস্মিক এই অন্যায্য সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেনি। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কেউ মানসিকভাবে প্রস্তুতও ছিল না। তাই ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। আন্দোলন দমনে বিভিন্ন সময় ১৪৪ ধারাসহ নানা আদেশ জারি করে এবং ঢাকা ও আশপাশের শহরে সমাবেশ-মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি বাংলাকে দেশের সিংহভাগ নাগরিকের ভাষা উল্লেখ করে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি জানান। সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদও জানান তিনি। তার এই বক্তব্য সমর্থন করেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত কয়েকজন গণপরিষদ সদস্য। পরিষদের মুসলিম লীগের সদস্যরা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। খাজা নাজিমুদ্দিনও প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন, পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষ চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান প্রস্তাবটিকে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির প্রচেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। দীর্ঘ বিতর্কের পর সংশোধনীটি ভোটে বাতিল হয়ে যায়। তার পরের ইতিহাস রাজপথের। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল রাজপথের। এদিন প্রশাসনের আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষার্থী ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকে। শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে ওঠে। শোকাবহ এ ঘটনার অভিঘাতে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছিল অনন্য অবদান। মাতৃভাষাপ্রেমী বঙ্গবন্ধু ১৯৪৭ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব এবং পরবর্তী সময়ে আইন সভার সদস্য হিসেবে ও পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বিশেষ ভূমিকা রাখেন। তিনি আমৃত্যু বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে কাজ করে গেছেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জেলে। সে সময় ব্যক্তি মুজিব রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসে নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতেন। ১৯৫২ সালের পর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু, সংসদের দৈনন্দিন কার্যাবলী বাংলায় চালু প্রসঙ্গে তিনি আইন সভায় তুলে ধরেন। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনেও বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম উদ্যোগ। ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অফিসের কাজে বাংলা ভাষা প্রচলনের প্রথম সরকারি নির্দেশ জারি করেন। ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই দিনটি জাতীয় শহীদ দিবস হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত হয়ে আসছে। দিবসটি উপলক্ষ্যে সংবাদপত্রসমূহে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হয় ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে। সরকারও বাংলা ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের একুশে পদক প্রদান করে। ২০০০ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে, যা এখন বিশ্বের বহু দেশে গভীর শ্রদ্ধা ও মর্যাদার সাথে উদযাপন করা হয়। এই ক্ষেত্রে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সে সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। জাতির পিতার কন্যার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দিবসটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে। একুশের ত্যাগ আমাদের শিক্ষা দেয় দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির সম্মানজনক স্থানে প্রতিষ্ঠা করার। আশার কথা, একুশের এই চেতনা এখন আরও উজ্জ্বলভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আর একুশের চেতনা আজ একীভূত। তাদের দেশপ্রেম আজ সকল উচ্চতায় স্থান করে নিয়েছে। বলা যায়, তরুণ সমাজ আজ তার অসীম শুভশক্তি নিয়ে দেশ গড়ায় মগ্ন। তারুণ্যের এই শুভশক্তির প্রভাব দেশব্যাপী। এটাই ইতিহাসের পাঠ, এটাই ইতিহাসের সাফল্য। কারণ, ইতিহাসের সত্য সব সময় প্রতিষ্ঠিত। বাঙালি তাজা রক্তের বিনিময়ে যেমন বাংলা ভাষাকে মায়ের বুকে স্থান দিতে পেরেছে, তেমনি জাতিকে পাকিস্তানিদের শোষণ-বঞ্চনামুক্ত করার জন্য নানা সময়ে আন্দোলন ও সংগ্রামের ভিত্তি রচনা করেছিল। এভাবে আন্দোলন ও সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠতে উঠতে ১৯৬৬ সালে বাঙালির মুক্তির সনদ বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা উত্থাপন করা হয়েছিল। বিশ্বে কোন স্বৈরাচারই ক্ষমতার বলে টিকে থাকতে পারেনি। পশ্চিম পাকিস্তানের একচ্ছত্র একগুঁয়েমি স্বৈরাচারও ১৯৭১ সালে টিকে থাকতে পারেনি। আমরা বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অবিরাম সংগ্রাম ও আন্দোলনের ফলে ১৯৭১ সালে দেশকে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আমরা সফল হয়েছি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত