ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

চাপের মুখে মিয়ানমার জান্তা

জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ল আরো ছয় মাস
চাপের মুখে মিয়ানমার জান্তা

মিয়ানমারে জরুরি অবস্থার মেয়াদ আবারও ছয় মাস বাড়িয়েছে দেশটির সামরিক সরকার। এর ফলে অভ্যুত্থানের পর জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের দেওয়া নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে আরও বিলম্ব হতে পারে। গত বুধবার দেশটির জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদ এ সিদ্ধান্ত নেয়। তবে বিলম্বে হলেও নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে জান্তা সরকার। তবে সেই প্রতিশ্রুতি কতটা তিনি রক্ষা করতে পারবেন সেটা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এদিকে দেশটির ওপর আন্তর্জাতিক চাপ দিন দিন বাড়ছে। এই অবস্থায় বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সেনবাহিনীর লড়াই দিন দিন তীব্র হচ্ছে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। অনেক সৈন্য পাশের দেশে পালিয়ে যাচ্ছে। নতুন করে সৈন্য নিয়োগ করার মতো পরিস্থিতি দেশটিতে নেই। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার জন্য দেশটির ওপর চাপ বাড়ছে। ফলে দেশটির সাধারণ মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিরোধিতার মোকাবিলার অজুহাত দিয়ে বিভিন্ন সময় জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়িয়েছে জান্তা সরকার।

২০০৮ সালের মিয়ানমারের সামরিক খসড়া সংবিধান অনুসারে, জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার ছয় মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন করতে হবে। সামরিক বাহিনীর দমন অভিযানে চার হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অং সান সুচির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার সময় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সামরিক বাহিনী। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থিদের বিক্ষোভ কঠোরভাবে দমন করে জান্তা। মিয়ানমারের প্রভাবশালী জান্তা নেতা ও সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান মিন অং হ্লাইং ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানে ক্ষমতা দখল করেন। তবে গত অক্টোবরে সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সমন্বিত হামলায় একের পর এক ফাঁড়ির নিয়ন্ত্রণ হারানো ও গুরুত্বপূর্ণ শহরে সেনাবাহিনীর ব্যর্থতার কারণে ৬৭ বছর বয়সি জান্তা প্রধানের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিদ্রোহীদের কাছে লড়াইয়ে ব্যর্থতার কথা প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও কিছু ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি মেনে নিয়েছে জান্তা সরকার। মিন অং হ্লাইংকে নিয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে গভীর হতাশা রয়েছে। সেনাবাহিনী নতুন সেনা সদস্য সংগ্রহ করতেও জটিলতায় পড়েছে। রণক্ষেত্রে পরাজয়ের লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে জান্তা প্রধানের নেতৃত্ব নিয়ে প্রকাশ্য সমালোচনা শুরু হয়েছে। ফলে বহুমুখি চাপে রয়েছে সেনাবাহিনী। ভূখণ্ড ও শহরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেনাবাহিনীর মনোবল ও নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর জান্তা সরকার অঙ্গীকার করেছিল ২০২৩ সালের আগস্টের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এ পরিস্থিতে গণতন্ত্রপন্থিদের বিক্ষোভ দ্রুতই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় সেনাবাহিনী কঠোরভাবে বিক্ষোভ দমন করে। এর ফলে তা দেশজুড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহের জন্ম হয় এবং আগে থেকে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে জান্তাবিরোধিতায় সমন্বয় গড়ে ওঠে। কয়েক দশক ধরে সেনাবাহিনীর প্রভাবিত শাসনে মিয়ানমারের অর্থনীত ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে।

বিদ্যুৎ বিপর্যয়ও জ্বালানিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ঘাটতি এবং আকাশছোঁয়া দামের কারণে দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। গণতন্ত্রপন্থিদের গঠিত বিদ্রোহী সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট জানিয়েছে, ছয়টি শর্ত মেনে নেওয়া হলে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আলোচনায় তারা প্রস্তুত। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে, সশস্ত্র বাহিনীকে বেসামরিক সরকারের অধীনে নিয়ে আসা এবং রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ বন্ধ করা। তবে এ ব্যাপারে মিয়ানমার জান্তার তাৎক্ষণিক কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। বিদ্রোহী গ্রুপে অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া অং সান সু চির দল এবং তিনটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। মিয়ানমারে ওপর আবারও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে এ পদক্ষেপ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২১ সালে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকে দেশটিতে সংকট চলছে। স্বাধীনতার পর থেকে সাত দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত চলমান থাকলেও, এবারের সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির জান্তা বা সামরিক শাসকরা। বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে ভূমির নিয়ন্ত্রণ হারানো ও প্রতিবেশী দেশে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের পালিয়ে আশ্রয় নেবার ঘটনা জান্তা সরকারের জন্য চরম আঘাত। ১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হবার পর থেকেই সে দেশে সংঘাত চলছে। ১৯৬২ সালে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।

এরপর দীর্ঘ সময় ধরে জান্তা বাহিনীর হাতে ক্ষমতা থাকলেও ২০১৫ সালের এক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি), যার নেতৃত্বে ছিলেন নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে দলটির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা সামরিক শাসকদের কাছে হুমকি মনে হওয়ায় পরের বছরের পয়লা ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয় সামরিক বাহিনী। তবে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি দেশটির সাধারণ জনগণ। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলে কঠোর হাতে তাদের দমন শুরু করে সামরিক বাহিনী।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী সারা দেশে ক্র্যাকডাউন চালায়। এতে ১৬ হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে নির্বিচারে গ্রেফতার এবং পুলিশ হেফাজতে ২৭৩ জনের মৃত্যুর তথ্য উঠে এসেছে। এছাড়াও গণহত্যা, গ্রেফতার, অত্যাচার, যৌন সহিংসতাসহ অন্যান্য নিপীড়নের কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সামরিক বাহিনী এরইমধ্যে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে ৪৩ শতাংশেরও বেশি জায়গা হারিয়েছে। দখল হারিয়েছে, ৩৩টি শহরের যা নিয়ন্ত্রণ করছে বিদ্রোহী বাহিনীর সদস্যরা। অক্টোবরে হামলা শুরু হবার পর থেকে হাজার হাজার সৈন্য তাদের সরঞ্জাম নিয়ে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। সারা দেশে বিদ্রোহী বাহিনীর কাছে সেনাবাহিনী ৪০০’রও বেশি সীমান্ত চৌকি হারিয়েছে। ২০১৫ সালে গণতান্ত্রিক উপায়ে এনএলডি ক্ষমতায় এলেও দেশের ওপর সার্বিক ক্ষমতা ছিল না দলটির। আর তার কারণ ২০০৮ সালের সংবিধান। এই সংবিধান অনুযায়ী, দেশটির সংসদের অন্তত ২৫ শতাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য বরাদ্দ থাকবে। সংসদে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সম্মতি ছাড়া সংবিধানের অন্যান্য ধারা ও আইন পরিবর্তন করা গেলেও ২০০৮ সালের সংশোধনীসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধারা পরিবর্তন করতে হলে অন্তত একজন সামরিক বাহিনীর সদস্যের সম্মতি থাকতে হবে। সামরিক শাসক মিন অং হ্লাইং বিদ্রোহি গোষ্ঠী’গুলোর সঙ্গে কোনও ধরনের আলোচনায় যেতে তিনি রাজি নন। আর সামরিক জান্তা-বিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীও সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, কোনোভাবেই তারা সামরিক শাসকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি না। ফলে সামরিক শাসকের ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া ছাড়া এই সংকট নিরসনের কোনও সুযোগ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত