তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

হামলার জবাবে হামলা শুরু হয়েছে। সিরিয়া এবং ইরাকের ৮৫টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি জর্ডানে তাদের এক সামরিক স্থাপনায় ড্রোন হামলার প্রতিশোধ হিসেবেই এই পাল্টা হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ড বলছে তারা ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড কুদস ফোর্স এবং সহযোগী অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর উপর হামলা করেছে। বাইডেনের বক্তব্যে এটি তাদের পাল্টা হামলা শুরু। এটি যদি শুরু হয় তাহলে মধ্যপ্রাচ্য এখন আবার জ্বলে উঠবে কি না এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত। লোহিত সাগরে হুথি বিদ্রোহীদের একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রের জাহাজ লক্ষ্য করে হামলা এবং বিপরীতে হুথিদের লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়ে উত্তেজনার মধ্যেই জর্ডানে ড্রোন হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের তিন সেনা নিহত হয়েছেন। হামলায় আহত হয়েছেন আরও প্রায় ৩৪ জন। সিরিয়া সীমান্তবর্তী জর্ডানের একটি সামরিক ঘাঁটিতে হওয়া এই হামলায় ইরান জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আর এর জেরে ইরানে হামলা চালাতে বাইডেনের ওপর রাজনৈতিক চাপ বাড়ছে বলে শোনা যাচ্ছে। এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোববার ইরান-সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় তিন মার্কিন সৈন্য নিহত এবং আরও কয়েক ডজন আহত হওয়ার ঘটনাটি ইরানে সরাসরি হামলা করার জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর রাজনৈতিক চাপ তৈরি করছে। যদিও বৃহত্তর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কায় মার্কিন এই প্রেসিডেন্ট এতদিন এই ধরনের কোনো পদক্ষেপ নিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। সামনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন। এই সময় বাইডেনের জন্য সামনে বেশ চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে বলে মনে করা হচ্ছে। এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্রমেই উপ্তত্ত হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতি এমন যে যুদ্ধাবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে বাইডেন ইরানের সাথে যুদ্ধে জড়াবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য উত্তপ্ত হলে বা যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বে জ্বালানি তেলের সরবরাহে একটি বড়সর ধাক্কা লাগবে। ফলে বেড়ে যেতে পারে জ্বালানি তেলের দাম। এর প্রভাবে বিশ্বজুড়েই জ্বালানি তেল নিয়ে সংকট বৃদ্ধি পাবে এবং মূল্যস্ফীতি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ বিশ্ব একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের দিকে চলে যাবে। আবার মার্কিন সামরিক বাহিনীর উপর হামলা চলতে থাকলে তা বাইডেন প্রশাসনকে চাপে ফেলবে যা ইতিমধ্যে চলছে। আমেরিকাকে নতুন করে কোনো অঞ্চলে যুদ্ধে জড়ানোটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। কারণ এমনিতেই যুদ্ধ পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলেছে এবং পৃথিবী যুদ্ধ থেকে নিষ্কৃতি চায়।

যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো পরাশক্তি। তাছাড়া ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও কার্যত এর পেছনের শক্তির একটি বড় অংশ যোগাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই বিষয়টি নিয়ে বেশ আক্রমণাত্বক মন্তব্য করেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং এবারের বাইডেনের সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্প। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও এই আক্রমণটিকে ‘জো বাইডেনের দুর্বলতা এবং আত্মসমর্পণের পরিণতি’ হিসাবে চিত্রিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জর্ডানে ইউএস মিলিটারি ইন্সটলেশনে ড্রোন হামলা এবং তিনজন আমেরিকান সৈন্যের নিহত ও আরও অনেকের আহত হওয়ার এই ঘটনা আমেরিকার জন্য একটি ভয়ংকর দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে... যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এই নির্লজ্জ হামলা জো বাইডেনের দুর্বলতা এবং আত্মসমর্পণের আরেকটি ভয়ংকর ও দুঃখজনক পরিণতি।’ এই ঘটনার জবাব দেওয়ার কৌশলগত সিদ্ধান্ত নির্বাচনেও প্রভাব ফেলতে পারে। ঠিক কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র এর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে তা ঠিক করবে বাইডেন প্রশাসন। যদি ইরানের অভ্যন্তরে হামলা হয় তাহলে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়তে পারে যা গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। আবার যদি যুক্তরাষ্ট্র নিরব থাকে যা থাকার সম্ভাবনা খুবই কম তাহলে তার সুযোগ রিপাবলিকানরা নিতেই পারে। যদি যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ায় তাহলে ইরানও তার প্রতিক্রিয়া জানাবে। তবে এই মুহূর্তে চাপ থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়াতে চায় না। ১৯৮০ সালে জিম্মি উদ্ধারের পর এখন পর্যন্ত ইরানের মাটিতে স্পষ্ট কোনো সামরিক অভিযান চালায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া ১৯৮৮ সালের পর সিরিয়া বা ইরাকের বাইরে ইরানের বাহিনীরও ওপরও কোনো হামলা চালায়নি দেশটি। বাইডেন প্রশাসন থেকে এমনটাই জানা গেছে। তবে সেই জবাব কী হতে পারে সেটা অনুমেয় নয়। নিষেধাজ্ঞা হতে পারে।

এর আগেও ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্র অনেক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। পরমাণু ইস্যুর সমাধান এখনও হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের আড়ালে ঢাকা পরে গেছে ইরানের পরমাণু ইস্যু। এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে ব্লিংকেনের বক্তব্য হলো ‘আমরা প্রতিক্রিয়া জানাব। সেই প্রতিক্রিয়া বহু-স্তরের হতে পারে। এটি পর্যায়ক্রমে আসতে পারে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থায়ীও হতে পারে।’ অর্থাৎ ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এই ইস্যুতে একটি গভীর সংকটের দিকে চলে গেলো বলেই ধরে নেওয়া যায়। গত কয়েক মাসে সম্পর্ক স্বাভাবিক না হলেও এতটা উত্তেজনার ছিল না। কয়েক বছর ধরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা কমানোর চেষ্টা করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র।

গত ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত প্রায় ২৬ হাজার ৭০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশ শিশু ও নারী। এ অবস্থায় যাতে উত্তেজনা আর না বাড়ে, সেজন্য চেষ্টা চলছিল। এখন সেটি আরও উত্তেজনার পর্যায়ে চলে গেলো। এর সাথে লোহিত সাগরে হুথিদের হামলা অব্যাহত থাকলে তো আরও এক কাঠি এগিয়ে থাকবে এই উত্তেজনা যা মধ্যপ্রাচ্যসহ সারা বিশ্বের জন্যই হুমকির হতে পারে। কারণ লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে ইদানীং হরহামেশাই হামলা চালাচ্ছে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা। আবার অন্যদিকে সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন বাহিনী লক্ষ্য করে অব্যাহত হামলার জন্য বাইডেন শুরু থেকেই ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলেকে দায়ী করছেন। ইরান তাদের সামরিক সহায়তা দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে। এই গোষ্ঠীগুলো ড্রোন ও রকেট দিয়ে হামলা পরিচালনা করছে। এভাবে বিভিন্ন স্থানে মার্কিন সেনাদের উপর হামলায় বাইডেনের উপর রাজনৈতিকভাবে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

রিপাবলিকানরা এ নিয়ে বেশ সরব। আর সামনেই নির্বাচন। যে কোনো সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক তা ভেবে-চিন্তেই নিতে হবে। কারণ গত কয়েকটি জরিপে বাইডেন পিছিয়ে আছেন তার সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে। এদিকে বিশ্বে কয়েকটি যুদ্ধ ঘোরতরভাবে চোখ রাঙাচ্ছে বহুদিন ধরেই। এর মধ্যে চলছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরাইল-হামাস যুদ্ধ, চীনের তাইওয়ানের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গী এবং বর্তমানের এই সংকট যেখানে যুক্তরাষ্ট্র দুই দিক থেকে বিপদে। ঘর এবং বাহির উভয় দিকেই বিপদে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮০ সালে জিম্মি উদ্ধারের পর এখন পর্যন্ত ইরানের মাটিতে স্পষ্ট কোনো সামরিক অভিযান চালায়নি যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া ১৯৮৮ সালের পর সিরিয়া বা ইরাকের বাইরে ইরানের বাহিনীরও ওপরও কোনো হামলা চালায়নি দেশটি। তবে এ নিয়ে একটি আশার কথা হলো ইরান সমর্থিত ইরাকি সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘কাতাইব হিজবুল্লাহ’ মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে তাদের সমস্ত সামরিক অভিযান স্থগিত ঘোষণা করেছে। গোষ্ঠীটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ইরাকি সরকারের বিব্রতকরণ রোধ করার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এটা ধরে নেওয়া যায় যে, সরাসরি যুদ্ধ হবে না অথবা আমেরিকা ইরানে সরাসরি সর্বাত্মক সামরিক অভিযান পরিচালনা করবে না। এর কারণ হলো মধ্যপ্রাচ্য অশান্ত হয়ে উঠলে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতে পারে। আবার ইরানের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করাও কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। সর্বোপরি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে তা থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাইরে থাকতে পারবে না।