বিশ্ব ইজতেমায় যৌতুকবিহীন বিয়ে

গড়ে উঠুক যৌতুকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন

প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমায় গতকাল শনিবার ৭২ জোড়া বর-কনের যৌতুকবিহীন বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। ওইদিন বিশ্ব ইজতেমার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ছিল যৌতুকবিহীন বিয়ে। সম্পূর্ণ ইসলামি শরিয়া মেনে তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ী ইজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশে বসে যৌতুকবিহীন বিয়ের আসর। কনের সম্মতিতে বর ও কনে পক্ষের লোকজনের উপস্থিতিতে বিয়ে সম্পন্ন হয়। এজন্য সকাল থেকে অভিভাবকরা হবু দম্পতির নাম তালিকাভুক্ত করান। বিয়ের পর বয়ান মঞ্চ থেকে মোনাজাতের মাধ্যমে সব নব দম্পতির সুখ-সমৃদ্ধিময় জীবন কামনা করার পাশাপাশি মঞ্চের আশপাশের মুসল্লিদের মাঝে খোরমা-খেজুর বিতরণ করা হয়। তাবলীগ জামাতের এই উদ্যোগটি অত্যন্ত মহৎ এবং প্রশংসনীয়। আমাদের সমাজে যৌতুক অভিশাপ হলেও এখন একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কন্যাসন্তান জন্ম নেয়ার পর থেকেই পিতামাতা তার বিয়ে নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। কোনো কোনো অভিভাবকের আর্থিক সঙ্গতি থাকলেও অধিকাংশেরই যৌতুক দেয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। সে কারণে আমাদের সমাজে যৌতুকবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে আমাদের যুব সমাজকে সবচেয়ে আগে এগিয়ে আসতে হবে। যুব সমাজ যদি অঙ্গীকার করেন যে, তিনি কনে পক্ষের কাছ থেকে কোনো প্রকার যৌতুক নেবেন না। তাহলে এই সামাজিক সমস্যার অধিকাংশই মিটে যায়। যৌতুকের জন্য বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে। তবে অনেক অভিভাবক মনে করেন, বর পক্ষকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করে দিতে পারলে তার কন্যা শ্বশুরবাড়িতে ভালো থাকতে পারবে। তবে সেই ধারণাও অনেক সময় ভুল প্রমাণিত হয়। যৌতুকবিহীন বিয়ের জন্য দেশের প্রচলিত আইন ও শরিয়ার অনুসাশন পূর্ণাঙ্গভাবে অনুস্মরণ করতে হবে। বিয়েতে মোহরানা ধার্য করা হয় ‘মোহর ফাতেমী’র নিয়মানুযায়ী। এ নিয়ম অনুযায়ী মোহরানা ধরা হয় দেড়শ’ তোলা রুপা বা এর সমমূল্যের অর্থ। বিবাহ একটি ইবাদত। ইসলামের দৃষ্টিতে মানবজীবনের যাবতীয় কর্মকালই ইবাদত। দাম্পত্য জীবন মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সুতরাং, দাম্পত্য জীবনের সূচনাপর্ব বিবাহ সুন্নত অনুযায়ী ও শরিয়াহসম্মতভাবে সম্পাদন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। দাম্পত্য যুগলবন্দি হওয়ার পদ্ধতিকে বাংলা পরিভাষায় ‘বিবাহ’ বা ‘বিয়ে’ বলা হয়। উর্দু ও ফারসি ভাষায় একে বলা হয় ‘শাদি’, আরবিতে বলা হয় ‘নিকাহ’। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় বিয়ের সময় বরের পক্ষ থেকে কনেকে যে অর্থ বা সম্পদ দেওয়া হয়, তাকে মহর বলে। বিবাহ সম্পাদনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘আকদ’। প্রস্তাব, গ্রহণ, সাক্ষী ও মহর হলো ‘আক্দ’ সম্পন্ন হওয়ার মৌল তিন উপকরণ। আর এর লিখিত রূপ হলো ‘কাবিন’। ‘মহর’ হলো বিয়ের সময় বর কর্তৃক কনেকে প্রদত্ত সম্মানী; যার মাধ্যমে সে স্বামীর অধিকার লাভ করে। মহর নগদে প্রদান করা উচিত। উভয় পক্ষের সম্মতিতে আংশিক বা সম্পূর্ণ বাকিও থাকতে পারে। তবে তা অবশ্যই পরিশোধযোগ্য। মহরের অর্থ একান্তই স্ত্রীর। এই অর্থ তিনি যেভাবে খুশি ব্যয় করতে বা সঞ্চয় রাখতে পারবেন অথবা বিনিয়োগ করবেন। তিনি যাকে ইচ্ছা দান-অনুদান বা উপহার ও হাদিয়া হিসেবে দিতে পারবেন। এতে স্বামী বা অন্য কারও কিছু বলার থাকবে না। ইসলামি বিধানমতে কনের পক্ষ থেকে বরকে বিয়ের সময় বা তার আগে-পরে শর্ত করে বা দাবি করে অথবা প্রথা হিসেবে কোনো দ্রব্যসামগ্রী বা অর্থ-সম্পদ ও টাকা-পয়সা নেওয়া বা দেওয়াকে যৌতুক বলে। শরিয়তের বিধানে যৌতুক সম্পূর্ণ হারাম ও নিষিদ্ধ এবং কবিরা গুনাহ বা মহাপাপ। বাংলা অভিধানমতে, যৌতুক হলো ‘বিবাহের পর বর বা কনেকে যে মূল্যবান দ্রব্যসামগ্রী উপহার দেওয়া হয়। মেয়ের বাড়িতে শর্ত করে আপ্যায়ন গ্রহণ করাও যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত। যৌতুক চাওয়া ভিক্ষাবৃত্তি অপেক্ষা নিন্দনীয় ও জঘন্য ঘৃণ্য অপরাধ। আমাদের দেশের আইনেও যৌতুক শাস্তিযোগ্য ও দণ্ডনীয় অপরাধ। যৌতুকের শর্তে বিয়ে সম্পাদিত হলে, বিয়ে কার্যকর হয়ে যাবে; কিন্তু যৌতুকের শর্ত অকার্যকর বলে বিবেচিত হবে। ইসলামি শরিয়তের বিধানমতে অবৈধ শর্ত পালনীয় নয়, বরং বাধ্যতামূলকভাবেই তা বর্জনীয়। তবে উপহার নিয়েও আমাদের সমাজে বিভ্রান্তি রয়েছে। নিঃশর্ত ও নিঃস্বার্থ দানকে উপহার বলা হয়। এই উপহার যে কেউ যে কাউকে যে কোনো সময়ে যে কোনো অবস্থায় যে কোনো অবস্থানে যে কোনো অবস্থান থেকে দিতে পারেন। সুতরাং, বিয়ের সময় বা তার পরে স্বামী স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে যে কোনো কিছু উপহার দিতে পারেন। বিয়ের সময় প্রদত্ত উপহারসামগ্রী বা অর্থের মালিক বর বা কনে। যে উপহার যাকে দেওয়া হয়েছে, তিনিই সেই উপহারের মালিক। তৃতীয় কোনো ব্যক্তি, যেমন শ্বশুর-শাশুড়ি বা অন্য কেউ মালিকের পূর্ব অনুমতি ছাড়া এসব উপহার কাউকে দিতে পারবেন না এবং যথেচ্ছ ব্যবহারও করতে পারবেন না। স্ত্রী বা কনে প্রাপ্ত উপহার নিজে ব্যবহার করা ছাড়াও যাকে খুশি কারও অনুমতি ছাড়া দিতে পারবেন। এতে স্বামী বা বরপক্ষের কারও কোনো এখতিয়ার থাকবে না; যদিও সেই উপহারসামগ্রী স্বয়ং স্বামী বা বরপক্ষই দিয়ে থাকে। যৌতুক ছাড়া বিয়ের আয়োজন আনুষ্ঠানিকতায় রূপ নেবে সেই কামনাই থাকবে।