ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার কবে হবে?

প্রদীপ সাহা
বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার কবে হবে?

ভাষা হচ্ছে মনের ভাব প্রকাশ করার সবচেয়ে উত্তম একটি মাধ্যম। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় পাঁচ থেকে ছয় হাজার মাতৃভাষা রয়েছে। বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা, আমাদের গর্ব-অহঙ্কার। সেই ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে পাকিস্তানি শাসক বাংলা ভাষাকে আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে এসেছে, কিন্তু পারেনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষাকে রক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক প্রতিবাদী ছাত্র ও আন্দোলনকারী মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেন। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনরত জনতার ওপর গুলি চালালে শহীদ হন রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ আরও অনেকে। পাকিস্তানি সরকার ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ভাষা আন্দোলন থেকেই জাগ্রত হয় জাতীয় চেতনা, বাঙালি অস্তিত্বের যোগসূত্র স্থাপন। আর এরই ফলস্বরূপ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় দেশ। বাংলা বর্ণমালার প্রতিটি অক্ষরে এখনো যেন লেগে আছে শহীদদের চাপ চাপ রক্ত। তাই বাংলা ভাষার সঠিক ব্যবহার ও প্রচলন নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ- এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে অনেকক্ষেত্রে বাংলার পরিবর্তে কিছু কিছু ইংরেজি শব্দ বাংলার মতো করে সহজেই ব্যবহৃত হচ্ছে। সঠিক বাংলা শব্দটার ব্যবহার যেন অনেকে ভুলেই বসেছে। তা সে শিক্ষিতই হোক কিংবা অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিতই হোক, সবার মুখে অত্যন্ত সহজ ও সাধারণভাবেই শব্দগুলো প্রচলিত হতে দেখা যায়। বাংলা ভাষার ব্যবহারেও রয়েছে এমন দুর্বলতা ও অজ্ঞতা। ভাষা নিয়ে এই যে দুর্বলতাণ্ডঅজ্ঞতা, এটা আমাদের কতটুকু লজ্জা দিচ্ছে এবং আদৌ কি আমরা লজ্জিত হচ্ছি? অবস্থাটা এখন এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, মনে হয় বাংলায় কথা বললে কেউ পেছন থেকে তিরস্কার করবে, হাসবে দাঁত বের করে। প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে- কেন আমরা বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না, কেন আমরা সঠিক বাংলাকে ভুলতে বসেছি? কেন মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে অকারণেই চলছে ইংরেজি শব্দের ছড়াছড়ি? ১৯৮৪ সালে এক নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছিল, ‘সব সাইনবোর্ড এবং গাড়ির ফলক বাংলায় হতে হবে। তবে কেউ প্রয়োজন মনে করলে নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লিখতে পারবে।’ গাড়ির নম্বর ফলক এখন একশ’ ভাগই বাংলায় হয়ে গেছে। কারণ কেউ তা ইচ্ছেমতো লাগাতে পারে না। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ডিজিটাল বাংলা নম্বরের ফলক নিতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। কিন্তু সাইনবোর্ড লেখার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। ছোটখাট দোকান, হোটেল বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বাংলায় সাইনবোর্ড দেখা গেলেও অভিজাত হোটেল, রেস্তোরাঁ, বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কিংবা শিল্প-কারখানার সাইনবোর্ড এখনো ইংরেজিতে লেখা হচ্ছে। অভিজ্ঞমহল মনে করেন, কঠিন আইন ও জরিমানার মাধ্যমে এ অনিয়মের অবশ্যই পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের সব রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। সংবিধানেও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের ভাষা ‘বাংলা’। কিন্তু এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা সম্ভব হয়নি। বাংলা ভাষা নিয়ে আরেকটি সমস্যা- এখন বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনে এখন সম্বোধন হিসেবে ‘ব্রো’ (ভাই), ‘সিস’ (বোন), ‘মেট’ (বন্ধু) ইত্যাদি শব্দগুলো বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো হচ্ছে ভাষাদূষণ। শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কোনো একটি কলামে লিখেছিলেন- ‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী’। তার মতে, বাংলাদেশে নদীদূষণ এবং ভাষাদূষণ দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এবং ক্রমাগত বাড়ছে। এটা বলা কঠিন যে, আদৌ দেশে পুরোপুরিভাবে বাংলা ভাষা চালু করা সম্ভব হবে কি না! যে ভাষার জন্য আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে, যে ভাষার জন্য জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করে শহীদ হতে হয়েছে- আমরা কি সেই বাংলা ভাষাকে, বাংলা ভাষার চর্চাকে আদৌ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছি? বর্তমান বানানরীতি নিয়েও রয়েছে নানা সমস্যা। বাংলা বানানের ভুল প্রয়োগ চলছে তো চলছেই। এই বানানের কারণে যে অনেক শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়, তা সবাইকে বুঝতে হবে। অন্যদিকে, বাংলার সঠিক উচ্চারণেও রয়েছে অনেক সমস্যা। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য এবং লজ্জাজনক। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষায় কথা বলেই আমাদের সারাটি দিন কাটে। পৃথিবীর কোথাও এমন মধুর ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না- এ কথা অনেক কবি-সাহিত্যিকও বর্ণনা করেছেন তাদের লেখাতে। শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, ভাষাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। জ্ঞান অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিকে রপ্ত করতে হলেও আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ভুলে গেলে চলবে না। এর সঠিক প্রয়োগ বা ব্যবহার অবশ্যই করতে হবে। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারি, কিন্তু আমাদের মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হবে অবশ্যই বাংলা। বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য এর সঠিক ব্যবহার এবং সঠিক প্রচলন অবশ্যই দরকার। গোটা জাতি যেন অন্তর থেকে এই রক্তের বিনিময়ে আনা বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারে এবং রক্ষা করতে পারে সেদিকে নজর দেওয়ার অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। তবে সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের মানসিকতায়। বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য আমাদের ইচ্ছেটাই প্রধান।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত