ঐতিহাসিক ভাষার মাসে আমরা মাতৃভাষা বাংলার জন্য আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার অনন্য সংগ্রাম ও আত্মত্যাগকে স্মরণ করি। আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ সব ভাষা শহীদদের- যারা বাংলা ভাষার মর্যাদা ও মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেছেন। ১৯৯৯ সালে দুজন প্রবাসী বাংলাদেশির উদ্যোগ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সক্রিয় সমর্থনে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং প্রচারের লক্ষ্যে ইউনেস্কো আমাদের ‘শহীদ দিবস’ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং যার অবিসংবাদিত নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাঙালির সংস্কৃতি ও পরিচয়ের একনিষ্ঠ প্রবক্তা।
তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাবক ছিলেন- যা ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ভাষা সংগ্রামীদের হত্যার ঘটনায় বঙ্গবন্ধু তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাভাষাকে তুলে ধরেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য ভাষাসৈনিক আব্দুল জব্বারের ভাষার প্রতি অমূল্য অবদান। জাতির পিতার স্নেহধন্য আব্দুল জব্বার ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাকে বঙ্গবন্ধু স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন। তিনি ছাত্র অবস্থাতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্র রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। আব্দুল জব্বার ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন ও ’৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৮-র আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন এবং ’৯০-র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। ভাষাসৈনিক আব্দুল জব্বার ১৯৬২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি, প্লেকার্ড প্রদর্শন ও শোভাযাত্রা করার কারণে গ্রেপ্তার হন ও কারারুদ্ধ ছিলেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্য মাসব্যাপী ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে পাড়া মহল্লা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সভা-সমাবেশ, শিক্ষার্থীদের সংঘঠিত ও উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি নিজ বাড়িতে ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে রাতভর হাতে লেখা পোস্টার ও প্লেকার্ড তৈরি করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৪ সালে কুলাউড়া শহরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়। বাংলাদেশ কৃষক লীগের প্রাক্তন সভাপতি আব্দুল জব্বার ১৯৬২-৬৪ সালে ছাত্রলীগের সংগঠক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি কুলাউড়া থানার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক তিনি রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি বাংলাদেশ কৃষক লীগেট কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সহ-সভাপতি ও ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৭১ সালে জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পর স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করতে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ওয়ারলেসে প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সশন্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। ৬ মে পাকিস্তানি বাহিনী কুলাউড়া আক্রমণ করলে তিনি তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন এবং সম্মুখ যুদ্ধে তার দুই সহযোদ্ধা শহীদ হন। পরবর্তীতে তিনি তার অন্যান্য সহযোদ্ধাদের নিয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধর্মনগরে চলে যান। ধর্মনগরে ইয়ুথ রিসিপসন ক্যাম্প চালু করে তার চেয়ারম্যান, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও শরণার্থী ব্যবস্থাপনার জন্য গঠিত জোনাল প্রশাসনিক কাউন্সিলের সদস্য এবং রিক্রুট ক্যাম্পের কো-চেয়ারম্যান হিসেবে সেখানে অবস্থারত জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের কৌশলগত বিভিন্ন দিক সম্পর্কে পরামর্শ ও পরিকল্পনা করেন। তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা মুজিব বাহিনীর ৪নং সেক্টরের অধিনস্থ মৌলভীবাজার সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে অসামান্য সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন, এছাড়া কুলাউড়া জংশন স্টেশনের মালবাহী ওয়াগন ভেঙে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে খাদ্য ও রসদসামগ্রী সরবরাহ এবং ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যার পর আব্দুল জব্বার ১৭ই আগস্ট কুলাউড়া শহরে প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিল ও গায়েবানা জানাজার আয়োজন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার হতে হয় এবং বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি মেজর নূর রাতভর অমানুষিক নির্যাতন করে, ভোরে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যার জন্য উদ্ধত হলে মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে তৎকালীন সেনা অফিসার জনাব আমিন আহমেদ চৌধুরী তাকে উদ্ধার করেন এবং তিনি প্রাণে বেঁচে যান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার প্রতিবাদণ্ডপ্রতিরোধ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করলে আবারও গ্রেপ্তার হন এবং কারাবরণ ও নির্যাতনের শিকার হন।
১৯৮৩ সালে বাকশাল গঠন করে আব্দুল জব্বারকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালে সদ্য সাবেক তরুণ পার্লামেন্টারিয়ান আব্দুল জব্বার তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বাকশাল যাতে সুসংগঠিত হতে না পারে সেদিকে জোরালো ভূমিকা রাখেন। এছাড়া ফ্রিডম পার্টি গঠন করা হলে তার মূলোৎপাটনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আব্দুল জব্বার ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় সংসদে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন। জাতীয় সংসদ সদস্য থাকাকালীন সময়ে তার প্রচেষ্টায় রাজনগর-কুলাউড়া-জুড়ী-বড়লেখা-বিয়ানীবাজার-শেওলা-চারখাই আঞ্চলিক মহাসড়ক (আর-২৮১) এর রাজনগর-কুলাউড়-জুড়ী পর্যন্ত রাস্তা পাকাকরণ করা হয়। অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান আব্দুল জব্বার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা, রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে প্রতিবাদে স্বোচ্চার থেকেছেন সবসময়। মাটি ও অবহেলিত মানুষের সাথে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। তার ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, সততা ও দেশপ্রেম সবাইকে অনুপ্রাণিত করে।
নন্দিত জননেতা আব্দুল জব্বার তার নির্বাচনি এলাকায় স্কুল-কলেজ, মসজিদণ্ডমাদ্রাসা, মন্দির, রাস্তা-ব্রিজ-কালর্ভাট, বিদ্যুৎ-সংযোগ প্রদান, ফায়ার সার্ভিস কেন্দ্র স্থাপন, গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ায় সাহায্য, দরিদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, চা-শ্রমিক, জেলে সম্প্রদায় ও উন্নয়নমূলক কাজের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি একজন শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী ও ক্রীড়া সংগঠক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি ও মানবসেবা এবং এলাকার উন্নয়নই তার একমাত্র ব্রত ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আব্দুল জব্বার ১৯৯২ সালে ২৮ আগস্ট শুক্রবার শোকের মাসে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : অ্যাসোসিয়েট এডিটর, ডিপ্লোমাটস ম্যাগাজিন