ঢাকা ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কেনাফ

রত্না খাতুন ও মো: আতাউর রহমান
অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কেনাফ

কেনাফ পাটের মতো পরিবেশবান্ধব আঁশ জাতীয় ফসল। যার বৈজ্ঞানিক নাম Hibiscus cannabinus। এটি মালভাসি পরিবারের একটি উদ্ভিদ যা ডেকান হেম্প, গিনি হেম্প এবং জাভা পাট নামে পরিচিত। বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, জামালপুর, নরসিংদী, নেত্রকোনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিরাজগঞ্জ, মাদারীপুর, শরিয়তপুর, গাজীপুর, চাঁদপুর ও গোপালগঞ্জ কেনাফ উৎপাদনকারী প্রধান জেলা।

মাটির স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের মতোই কার্যকর ভূমিকা পালন করে এ ফসল। হুবহু পাটের মতোই, তবে পাট নয়। পাটের চেয়ে এর ফলন বেশি। সেচের প্রয়োজন হয় না। যে জমিতে বোরো আবাদ করা সম্ভব নয়, সাধারণত অনাবাদি থাকে বা কোথাও তিলের চাষ করা যায়, কিন্তু বৃষ্টিতে ফসলহানি হয়, সেই জমিতে কেনাফের চাষ করে কৃষক আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উঁচু, মধ্যম, নিচু, হাওর এলাকা, পাহাড় এলাকার ঢালু জমি এবং উপকূলীয় ও চরাঞ্চলের ফসল উৎপাদনের উপযোগী নয় বা আউশ ফসলের জন্য লাভজনক নয় এমন অনুর্বর জমিতেও কেনাফ অল্প পরিচর্যায়ও ভালো ফলন পাওয়া যায়। তাছাড়া এটি দেশের প্রায় সব জেলায়ই উঁচু-নিচু ও মাঝারি জমিতে বপন উপযোগী। পাটের চেয়ে কেনাফ নিড়ানি ও পরিচর্যা কম লাগে। বাংলাদেশে খুব সহজে ও অনায়াসে কেনাফ চাষ করা যায়। কেনাফ-৩ গাছের মূল মাটির ১২ থেকে ১৫ ইঞ্চি বা তার বেশি গভীরে প্রবেশ করে মাটির উপরিস্তরে সৃষ্ট শক্ত প্লাউপ্যান ভেঙে দেয় এবং তলিয়ে যাওয়া বিরল পুষ্টি উপাদান শিকড়ের সাহায্যে মাটির নিচ থেকে সংগ্রহ করে তা পরে গাছের পাতার সাহায্যে জমির উপরিস্তরে ফিরিয়ে দেয়। পাতা পচে জমির উর্বরতা বাড়ায়। কেনাফ গাছের খড়ি জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হওয়ায় জ্বালানি সমস্যার অনেকটাই দূর করতে সাহায্য করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি হেক্টরে ১০০ দিন সময়ের কেনাফ জাতের পাতা বায়ুমণ্ডলের ১৪ দশমিক ৬৬ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে নেয়ার পাশাপাশি বায়ুমণ্ডলে ১০ দশমিক ৬৬ টন অক্সিজেন নিঃসরণ করে বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধ ও অক্সিজেনসমৃদ্ধ রাখে। দেশের অনাবাদি অনুর্বর ও লবণাক্ত জমিতে কেনাফ চাষ করে বছরে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকাসহ দেশে ফসল চাষের অনুপযোগী প্রায় ১০ লাখ হেক্টর জমি প্রতি বছর অনেকটাই পতিত পড়ে থাকছে। অথচ এসব জমিতে অল্প পরিচর্যা ও কম খরচে অধিক ফলনশীল কেনাফ চাষ করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনার নতুন দুয়ার খুলে যেতে পারে। পাটের মতো এর পাতা এবং ফলও খাওয়া যায়। ফল দিয়ে আচার তৈরি হয়। পৃথিবীর বহু দেশে এ জাতের আঁশের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। শুধু তাই নয়, কেনাফের আঁশ থেকে কাগজের মন্ড ও বীজ থেকে শতকরা ২০ ভাগ ভোজ্যতেলও পাওয়া যায়। ফলে বিপুল সম্ভাবনাময় এ ফসল চাষ দেশের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কেনাফ চাষে প্রতি বিঘা থেকে ১২ মণের বেশি আঁশ সংগ্রহ করা যায়। যা টেক্সটাইল শিল্পের জন্য বেশি গুরুত্বপূর্ণ। টেক্সটাইল ক্ষেত্রে হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে কেনাফ ফাইবার ব্যবহার করা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেনাফ আঁশ- দড়ি এবং মোটা কাপড় যেমন; ক্যানভাস, বস্তার কাপড়, কার্পেট ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও কেনাফ আঁশ দ্বারা আরও অনেক ব্যবহার্য উপাদান প্রস্তুত করা যায়। যেমন: স্টোরেজ ব্যাগ, কুটির শিল্পজাত দ্রব্য, মাদুর, স্যান্ডেল, জায়নামাজ, টুপি, সোফা ও কুশনের কাভার, পর্দার কাপড়, বেডশিট, পাঞ্জাবি, সোয়েটার, প্লেন, মোটর, কম্পিউটার ইত্যাদির পার্টস। কেনাফ আঁশ থেকে উৎপন্ন পণ্য রিসাইকেল করা যায়। খুলনা-বরিশাল উপকূলীয় অঞ্চলের লবণাক্ততা ও খরাপ্রবণ এলাকাতেই বাড়তি ফসল হিসেবে অফ সিজনে কেনাফ চাষ করা যায়। যা দিয়ে নিউজ প্রিন্ট মিলের প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সরবরাহের পাশাপাশি হার্ডবোর্ড বা পার্টেক্স মিলের কাঁচামাল, পশুখাদ্যের কাঁচামাল, তেল উৎপাদন এবং বিদেশে প্রাইভেট কারসহ বিভিন্ন ইনটেরিয়র কাজের ইনস্যুলেটর হিসেবে কেনাফ ব্যবহার সম্ভব। আর অফ সিজনে পতিত জমিতে কেনাফ চাষ করতে পারলে কৃষকের আয়বৃদ্ধি, শ্রমশক্তি ব্যবহার সম্ভব হবে। এর ফলে পরিবেশেরও উপকার হবে। কেনাফ চাষের সম্ভাবনা সম্পর্কে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের এক সূত্রে জানা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আমাদের উপকূলের কৃষিকে খাপ খাইয়ে নিতে প্রচলিত কৃষি থেকে কৃষকদের নির্ভরতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাটের বিকল্প হিসেবে কেনাফ চাষে কৃষকদের সম্পৃক্ত করা গেলে তা এ অঞ্চলের কৃষিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে। অনাবাদি, অনুর্বর জমিতে অল্প পরিচর্যা ও স্বল্প খরচে ১১০ দিন থেকে ১২০ দিনে কর্তন করে কেনাফের ভালো ফলন পাওয়া যায়। কেনাফ বন্যার পানিতেও বেঁচে থাকে। এটি সহজে পোকামাকড়ে আক্রান্ত হয় না। এ অঞ্চলে লবণাক্ততার কারণে অন্য ফসলের আবাদ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই কেনাফের আবাদ বিস্তার করা যেতে পারে। পরিবেশবান্ধব বহুমুখী কাজে ব্যবহারযোগ্য কেনাফকে পাটের পরিপূরক হিসেবে বিবেচনা করে যেসব প্রান্তিক ভূমি পাট চাষের উপযোগী নয়, তার এক উল্লেখযোগ্য অংশ কেনাফ চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে দেশে অধিক আঁশ উৎপাদনের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত করা সম্ভব হবে এবং অর্থনৈতিক সংকটের অবসান হবে। বিদেশি ঋণের পরিবর্তে দেশীয় উৎস কেনাফের সদ্ব্যবহার আমাদের দেশের জন্য অনেক বেশি সুলভ ও লাভজনক হবে।

লেখক : বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ১ ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ২। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত