মিয়ানমার পরিস্থিতি বাড়াতে পারে আঞ্চলিক সংকট

অলোক আচার্য

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ মিয়ানমারে জান্তার অভ্যুত্থানের ৩ বছরের মাথায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পরেছে জান্তা সরকার। দেশটির অস্থিরতা বিগড়ে দিতে পারে আঞ্চলিক অস্থিরতা। রোহিঙ্গা ইস্যুও নতুন করে ছড়িয়ে পরতে পারে। মিয়ানমারে বিদ্রোহীদের সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর বিরতিহীন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্যে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে সশস্ত্রদের অনুপ্রবেশ ঘটছে বাংলাদেশে; তাদের অনেকে আহত হয়েই যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। প্রতিদিনই আসছে। স্থানীয়দের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, ৩ মাসের বেশি সময় ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ চালিয়ে বিদ্রোহীরা দেশটির শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যের ৩০টিরও বেশি শহর দখলে নিয়েছে। বিদ্রোহী বাহিনীর হাতে জান্তা সরকারের সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি সেনা নিহত বা আটক হয়েছেন। এদের মধ্যে ১০ জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রয়েছেন। মিয়ানমার সেনা ও বিদ্রোহীদের বিরতিহীন সংঘাতে সীমান্ত গলিয়ে ভারত-চীনের মতো বাংলাদেশেও অনুপ্রবেশ ঘটছে সশস্ত্র সেনাদের। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের (বিজিবি) তথ্য অনুযায়ী নতুন করে সংঘাত শুরু হওয়ায় গত পাঁচ দিনে গত মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রম্ন সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ২২৪ সদস্যের অনুপ্রবেশ ঘটেছে দেশে। এদের নিরস্ত্র করে আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছর অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী দেশজুড়ে ক্র্যাকডাউন চালায়। এতে ১৬ হাজারেরও বেশি গণতন্ত্রকামী মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ হেফাজতে মারা যান ২৭৩ জন। এ ছাড়া নির্বিচারে গণহত্যা, গ্রেপ্তার, অত্যাচার, যৌন সহিংসতাসহ অন্য নিপীড়নের কথাও প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়েও দেওয়া হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে এ অঞ্চল অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। পাশ্ববর্তী একটি দেশে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করলে তার প্রভাব পরতে পারে। বিশেষত যখন বাংলাদেশে আগে থেকেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গত কয়েক বছর আশ্রয়ে রয়েছে। তাদের জন্য এর মধ্যেই বহুমুখী ঝুঁকিতে রয়েছে দেশ।

তিন বছর আগের জান্তা সরকার আর আজকের জান্তা সরকার এক অবস্থায় নেই। আজকের জান্তা সরকার অনেকটাই সেদিনের চেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতে রয়েছেন। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দেশটির নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয় সামরিক বাাহনী। ২০২১ সালে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী বলে বিশ্বখ্যাত অং সাং সু চিকে গৃহবন্দি করার পর মিয়ানমারের জান্তা সরকার যে ধরনের রাজনৈতিক এবং আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে ছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তিত হয়েছে। তখন থেকেই মানুষের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বলছিল। সেই আগুন এখন জান্তা সরকারকেই গিলে খাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অবস্থা এখন জান্তা প্রধান হ্লায়িং-এর সম্পূর্ণ প্রতিকূলে রয়েছেন। এমনকি জান্তা সরকার হিসেবে তা সময় হয়তো বা শেষ এমনটা ধারণা করা হচ্ছে। কারণ বিদ্রোহীদের কাছে প্রতিনিয়ত তার সেনাবাহিনী মার খাচ্ছে। অনেক সৈন্য বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং করছে। মিয়ানমারের বিদ্রোহীদের গঠন করা জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনইউজে) দাবি করেছে, দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে জান্তাবিরোধীরা এ পরিস্থিতির মধ্যেই মিয়ানমারে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে জারি থাকা জরুরি অবস্থার মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে সামরিক শাসকরা। তারপর থেকে দেশের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশটিতে সংঘাত সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেড়ে গেছে।

১৯৪৮ সালে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই সে দেশে সংঘাত চলছে। ১৯৬২ সালে দেশটির ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী। এরপর দীর্ঘসময় ধরে জান্তা বাহিনীর হাতে ক্ষমতা থাকলেও ২০১৫ সালের এক নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি), যার নেতৃত্বে ছিলেন নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি। ২০২০ সালের নির্বাচনে দলটির ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা সামরিক শাসকদের কাছে হুমকি মনে হওয়ায় পরের বছর, অর্থাৎ ২০২১ সালের পয়লা ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবারও ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয় সামরিক বাহিনী। তবে এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি, দেশটির সাধারণ জনগণ। প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এলে কঠোর হাতে তাদের দমন শুরু করে সামরিক বাহিনী। জাতিসংঘের হিসাবমতে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে লড়াই-সংঘাতে প্রায় ২০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সম্প্রতি সেখানে জাতিগত বিদ্রোহীরা গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন শহর দখল করছে। প্রথম ২ বছর আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন আক্রমণ করলেও ২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর সেনাবাহিনীর ওপর একজোট হয়ে হামলা চালায় এ তিন বিদ্রোহী বাহিনী-ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ), তায়াং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মিস (টিএনএলএ) এবং আরাকান আর্মি (এএ)। যাদের বলা হয় থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। ‘ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স দাবি করছে, এটি ২৫টি সামরিক চৌকি, এক ডজন শহর এবং চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যের অংশ ৫টি প্রধান সীমান্ত ক্রসিং দখল করেছে এ অভিযানের নাম দেন ‘অপারেশন-১০২৭’। তখন থেকে পরিস্থিতিও পাল্টে যেতে থাকে। এমর পরিস্থিতিতে জান্তা সরকার ক্ষমতা কতদিন ধরে রাখতে সক্ষম হবে সেই প্রশ্ন আন্তর্জাতিক মহলে।

ক্ষমতা দখলের পর থেকেই বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে সামরিক সরকার। এর ফল হয়েছে উল্টো। জনসমর্থন হারিয়ে তিনি একা হয়ে পরেছেন। তার বিরুদ্ধে গেছে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং ক্ষুদ্র জাতি সত্ত্বার লোকজন। গৃহযুদ্ধের কবলে মিয়ানমার এখন বিধ্বস্ত একটি দেশে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্রের দরজা বন্ধ করে যে ভুলের সূচনা হয়েছে তার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষ এবং সেনাবাহিনী উভয়কেই। কারণ সেনাবাহিনীর সদস্যরা নিজেদের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছেন।

তারা ক্লান্ত। তাদের অনেকেই যে ক্লান্ত বা যুদ্ধ করতে আর বেশি আগ্রহী নয়, সেটা তাদের আত্মসমর্পণের খবরেই বোঝা যায়। আর এ ধরনের গৃহযুদ্ধে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়কর অবস্থার মুখোমুখি হয়। এর আগেও মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতায় ছিল। তখন এত সমস্যায় পরতে হয়নি। তখনও অং সান সূ চি গৃহবন্দি ছিল। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। উত্তর সীমান্তের চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের দুটি ব্যস্ততম বাণিজ্য কেন্দ্রও গত মাস থেকে শান রাজ্যের জাতিগত সংখ্যালঘুদের আক্রমণের ফলে অবরুদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। এসব অবরোধের কারণে মিয়ানমারের আন্ত সীমান্ত বাণিজ্য মুখ থুবড়ে পড়েছে। নগদ অর্থ সংকটে থাকা জান্তা সরকার কর ও বৈদেশিক লেনদেন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জান্তা প্রধানের পদত্যাগেই সমাধান হবে না। ২০১৭ মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়ংকর সহিংসতা শুরু করার পর থেকে রোহিঙ্গারা ধর্ষণ, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগ থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মানবতার দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় প্রদান করে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ধৈর্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। কূটনৈতিক পর্যায়ে এর সমাধান খুঁজতে হবে। এখানে বড় দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র চীন ও ভারতের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এই দুই দেশের সহযোগিতায় এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। যদি আশ্রিত বিজিপি, সেনাবাহিনী সদস্যদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে, তাদের কত দ্রুত এবং কীভাবে ফেরত পাঠানো হবে, সে কৌশল স্থির করতে হবে।